বাসস
  ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৮

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা

॥ মো. মঞ্জুর মোর্শেদ ॥
মুন্সীগঞ্জ, ১২ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ২৫০ শয্যায় রুপান্তরীত হলেও সেবার পরিধি বৃদ্ধি না পাওয়ায় মুন্সীগঞ্জ বাসী উন্নত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল নামে মাত্র ২৫০ শয্যার  হাসপাতাল  হয়েছে।অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ১০০ শয্যার হাসপাতালে মোট জনবল সংখ্যা হলো ১৯৪ জন।  সেখানে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী  ২২৩ টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ১৩১ জন। জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক  চিকিৎসা সেবা। চিকিৎসকদের সেবার মনোভাবের অভাব , বেড সংকট ,  অব্যবস্থাপনা , অপরিস্কার ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম। হাসপাতারে নেই কোন আইসিইউ ব্যবস্থা ।

চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা হাসপাতালের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ছুটে যাচ্ছে ক্লিনিকে আর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সিনিয়র কনসালটেন্টের অভাবে জটিল রোগের রোগীরা কোন উন্নত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে অন্যত্র।এ সুযোগে শহরের হাসপাতাল এবং আশ পাশ এলাকায়  গড়ে উঠেছে অর্ধ শত ডায়াগনষ্টিক সেন্টার আর ক্লিনিক।হাসপাতালে সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল চক্র । অযত্ন আর টেকনিশিয়ানের অভাবে নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি ২০০৬ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০শয্যায় উন্নীত করা হয়। পরে ২০২৩ সালে ডিসেম্বরে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় রুপান্তরীত করা হয় । ১০০ শয্যার হাসপাতালকে ২৫০শয্যায় উন্নীত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় নতুন ভবন নির্মানের প্রকল্প হাতে নেয়। গত ২০১১ - ২০১২ অর্থবছরে বিদেশী সংস্থা জাইকা ও বাংলাদেশ সরকারের  অর্থায়নে ৩১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরাতন ভবনের পাশে ৭ তলা বিশিষ্ট নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। বিভিন্ন জটিলতায় ২ বছর কাজ বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে এর নির্মান কাজ শেষ হয় । অবশেষে ১০ বছর পর ভবনটিতে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ জেনারের হাসপাতালের তত্বাবধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. দেওয়ান নিজামউদ্দিন আহম্মেদ বাসসকে বলেন ,প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক ,নার্স এবং ক্লিনারের অভাবে কাক্ষিত স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট  মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে  অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সর্বমোট পদ রয়েছে ২২৩ টি । ডাক্তার , নার্স , ষ্টাফ সহ কর্মরত রয়েছেন ১৩১ জন , শূন্য রয়েছে তত্বাবধায়ক এবং সহকারী পরিচালক সহ ৯২টি পদ। চিকিৎসকের  পদে ৫৭টির বিপরীতে  কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৩৯ জন ,শূন্য রয়েছে ১৮টি পদ। ৯৯জন নার্সের পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫৬ জন, শূন্য রয়েছে ৪৩ টি পদ। ১২জন সিনিয়র কনসালটেন্টের পদের মধ্যে কর্মরত আছেন ১জন। সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) ,সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ,সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারী), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু) সহ ১১ টি পদই শূন্য  রয়েছে। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে নেই কোন চক্ষু চিকিৎসা। সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু) না থাকায় গত ৪ বছর যাবৎ এখানে চোখের কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। শূন্য রয়েছে নার্সিং সুপারেনডেন্ট ও প্যাথলোজিষ্ট পদটিও।
সরেজমিনে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় , অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে চলছে স্বাস্থ্য সেবা। ড্রেনে নোংরা ময়লা পানি জমে আছে।পুরাতন ভবনের  মহিলা ওয়ার্ডের সামনে পিছনে আগাছা , ময়লা আর্বজনাপূর্ণ। নতুন ভবনের ওয়ার্ডের করিডোরে ময়লা আবর্জনায় , বর্জে নোংরা হয়ে আছে।

বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবার কার্যক্রম খুবই নাজুক  রোগীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।বহির্বিভাগে ১০০ শয্যার সময় ও ছিল ১ জন মেডিকেল অফিসার আর ২৫০ শয্যার হাসপাতালেও রয়েছে ১ জন মেডিকেল অফিসার।  ঘড়ির কাটায় তখন ২ টা বাজে। বহির্বিভাগ মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকের কক্ষের সামনে ২০/৩০ জন রোগী লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ এসেছে রিপোর্ট দেখাতে , কেউবা নতুন রোগী। শহরের মাঠপাড়া থেকে আসা খালেক বলেন, ২ ঘন্টা দাড়িয়ে থেকেও ডাক্তার দেখাতে পারছি না । এর কিছুক্ষন পর ডাক্তার লাইনে রোগী রেখেই চলে গেলেন। রামপাল খেকে আসা নান্নু বাগজা মেয়েকে নিয়ে শ্বাসকষ্ট এবং বুকের ব্যথা নিয়ে এসেছেন ।তার  মেয়ে আসমা বলেন , হাসপাতালে রক্ত এবং ইসিজি পরীক্ষা করাতে সময় লাগবে বলে বাহির থেকে  পরিক্ষা করালাম আজ ডাক্তার দেখাবো বলে, কিন্তু ডাক্তার চলে গেলন,দেখাতে পারলাম না। রিকাবীবাজার থেকে আসা পঙ্গু শাহ আলম সারা দিন অপেক্ষা করেও ডাক্তার দেখাতে পারলো না।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আওয়াতিফ ইবনে মতিন বাসসকে বলেন ,পর্যাপ্ত চিকিৎসক ,নার্স , সিষ্টার ও ওয়ার্ড বয় না থাকায় রোগীদের কাংক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। সিনিয়র কনসালটেন্ট না থাকায় আইসিও বেড চালু করা যাচ্ছে না। মূল্যবান যন্ত্রপাতি পরে থেকে নষ্ট হচ্ছে।মেডিকেল অফিসার কম থাকায় বহির্বিভাগে একাধিক মেডিকেল অফিসার দেওয়া যাচ্ছে না। নিরাপত্তা কর্মীর কোন পদ নেই। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আরো বলেন , ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ক্লিনারের পদ মাত্র ৭টি এর মধ্যে কর্মরত আছে মাত্র ৩ জন।  জনবল সংকটের কারণে এত বড় হাসপাতাল পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আউট সোসিং এর মাধ্যমে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়।নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় তারা কাজ করছে না। চলতি অর্থ বছরে কোন বরাদ্ধ না পাওয়ায়  কোন নিয়োগ হয়নি।

মহিলা ওয়ার্ডের অবস্থা খুবই খারাপ।ভর্তি হওয়া রোগী ওয়ার্ডে বেড না পেয়ে করিডোরে মেঝেতে থাকছে । গ্যাসস্টিকের  ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আমঘাটার মাকসুদা  বেগম ( ৩৫) বলেন ,সিট না থাকায় বারান্দায় থাকছি। কবে সিট পাবো জানি না।নাক কান গলা বিভাগে রোগীরা ভালো সেবা পায়না।অভিযোগ রয়েছে কর্মরত কনসালটেন্ট  রোগীদের  ভালো চিকিৎসার আশ্বাস দিয়ে নিজস্ব চেম্বারে যেতে প্ররোচিত করেন।

মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে দাঁতের চিকিৎসা নিতে আসা রহিমা বেগম বলেন, সকাল থেকে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করছি ডাক্তার দেখাতে পারছি না। চক্ষু দেখাতে আসা আব্দুস সালাম বলেন,বাহিরে চক্ষু অপারেশনে  অনেক টাকা  খরচ। জেলা সদর হাসপাতালে এসেও চিকিৎসা করাতে পারলাম না।এখানে বড় ডাক্তার নেই।

গাইনী বিভাগের অবস্থা খুবই নাজুক।হাসপাতালে একটি মাত্র অপারেশন থিয়েটার থাকায় সপ্তাহে মাত্র দুই দিন গাইনি অপারেশন করা হয়।অধিকাংশ গাইনী রোগী বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছে স্থানীয় ক্লিনিকে। এ সব ক্লিনিকে গলা কাটা ফি নেওয়া হয়। গাইনি রোগী দিয়ে চলছে এসব কিøনিক। সদর হাসপাতালের সাবেক আবাসিক মেডিকের অফিসার ডা. এহসানুল করীম বাসসকে বলেন , গাইনি বিভাগের জন্য আলাদা অপারেশন থিয়েটার এবং নরমাল ডেলিভারী রুম থাকলে ভালো সেবা নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমান অবস্থায় হাসপাতালে সপ্তাহে চার দিন অপারেশনের ব্যবস্থা থাকলে  প্রান্তিক জনগোষ্টি গাইনি চিকিৎসায় আর্থিক ভাবে উপকৃত হবে। হাসপাতালে ২ জন অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার থাকলেও অ্যামবুলেন্স সচল রয়েছে একটি ।