বাসস
  ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৫১
আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৫৯

রমেক হাসপাতাল উত্তরাঞ্চলের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি

॥ মো: মামুন ইসলাম ॥

রংপুর, ১৩ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে প্রতিদিন শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার আশায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা এসব রোগী এ হাসপাতালে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। ফলে প্রতিষ্ঠার ৫৪ বছর পরও হাসপাতালটি উত্তরাঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা এখনো পূরণ করতে পারেনি। 

দীর্ঘদিনের অন্তহীন সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ হাসপাতালটিতে আসা অধিকাংশ রোগীই বিরাজমান পরিবেশ ও সার্বিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে চরম অসন্তোষ ও হতাশা ব্যক্ত করেন।
গত কয়েকদিন ধরে হাসপাতালটির বিভিন্ন বিভাগ ও ওয়ার্ডে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে সেখানে অপর্যাপ্ত জনবল, অপ্রতুল শয্যা সংখ্যা, চাহিদার বিপরীতে অপর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ, নোংরা টয়লেট ও দুর্গন্ধময় পরিবেশ এবং বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আর্বজনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। 

হাসপাতালটিতে একশ্রেণীর দালাল ও সিন্ডিকেটের কারণে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।

রমেক হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. ছাইফুল ইসলাম বাসসকে জানান, ১৯৭৬ সালে রমেক হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। ওই সময় হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যা ছিল ২৫০। ১৯৮৬ সালে এটিকে ৫০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এর সাত বছর পর ১৯৯৩ সালে শয্যা সংখ্যা  বাড়িয়ে ৬০০ করা হলেও বাড়ানো হয়নি জনবল। একই জনবল কাঠামো নিয়ে ২০১০ সালে হাসপাতালটিকে এক হাজার শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি বাড়ানো হয়নি জনবল। ফলে এখনো ৫০০ শয্যার জনবল কাঠামো দিয়েই চলছে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। 

১৯৮৬ সালে এ হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মোট ১,৯৮১ জনের জনবল কাঠামো অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদিত জনবলের মধ্যে রয়েছে চিকিৎসক ২৯১ জন, নার্স ১,০২৬ জন, ডেন্টাল সার্জন ২৩ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৪০ জন, তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী ১৩৯ জন, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ৪৪৫ জন এবং নিরাপত্তা প্রহরী ১৭ জন।

হাসপাতালটিকে এক হাজার বেডে উন্নীত করার জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবলের চাহিদা বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠানো হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কোনো অর্গানোগ্রাম অনুমোদন পাওয়া যায়নি। ফলে হাসপাতালটি বর্তমানে চরম জনবল সংকটের মুখে পড়েছে। 

ছাইফুল জানান, পূর্বের ৫০০ বেডের জন্য অনুমোদিত জনবল ১,৯২১ জনের বিপরীতে বর্তমানে হাসপতালটিতে ১,৬৮০ জন জনবল রয়েছে। 

এ জনবল দিয়েই বর্তমানে এক হাজার বেডের রমেক হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। জনবল সংকটের কারণে হাসপাতালের অনেক কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। 

বর্তমানে রমেক হাসপাতালে আধুনিক সিসিইউসহ মোট ৪২টি ওয়ার্ড, ১২টি ওটি, ১০ শয্যার আইসিইউ, ২৫ শয্যার ডায়ালাইসিস ইউনিট, ৬ শয্যার ডে-কেয়ার ইউনিট, ভায়া সেন্টার, ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং সেন্টারে রোগীদের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে।

রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সাথে কথা বলে নানা রকম দুর্ভোগের তথ্য জানা যায়। হাসপাতালটির বিভিন্ন ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির পর শয্যা না পেয়ে তারা মেঝেতে বা আশেপাশের করিডোর ও বারান্দাতে চরম অস্বস্তিকর পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অধিকাংশ ওয়ার্ডেই শয্যার চেয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। ফলে চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়রা রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। একইসাথে রোগীরাও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন না। তাদেরকেও পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ ও ভোগান্তি। 

রোগীরা জানান, হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ না পেয়ে তাদেরকে বেশিরভাগ ওষুধ বাইরে থেকে ক্রয় করতে হচ্ছে। হাসপাতালে সব ধরনের টেস্ট না হওয়ায় আশেপাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোতে গিয়ে এসব পরীক্ষা করাতে তাদেরকে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। ফলে চিকিৎসা নিতে আসা  রোগীরা অসহায় হয়ে পড়ছেন।

মেডিসিন বিভাগের ২৯/৩০ নম্বর ওয়ার্ডের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) কর্নারে ভর্তি হওয়া রোগী রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা সদরের বিপুল চন্দ্রের স্ত্রী রিতা রানী জানান, বুকে ব্যথা নিয়ে তার স্বামীকে মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে ভর্তি করানো হয়। শয্যা সংকটের কারণে তাকে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। পরদিন সকালে একজন চিকিৎসক তাদের সাথে মিনিটখানেক কথা বলে ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান। ওষুধগুলোও হাসপাতালে না পাওয়ায় তাদেরকে বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। 

নীলফামারী জেলার নতুন পুলিশ লাইনস এলাকার রোগী আব্দুল বাতেন (৬৫) কিডনীর অসুস্থতা নিয়ে গত শুক্রবার একই ওয়ার্ডে ভর্তি হন। তার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম অভিযোগ করে বলেন, তাদের সাথে ডাক্তার ঠিকমত কথা বলেন না এবং শুধু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান। 

দিনাজপুরের পার্বতীপুরের রোগী মো. মাসুদ (৪২) কিছুদিন আগে ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সেখানে চিকিৎসা নিয়ে নিজ বাড়ি পার্বতীপুরে ফিরে এসে পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি গত মঙ্গলবার সরকারী রমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একই ওয়ার্ডের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) কর্নারে ভর্তি হন। সিট খালি না থাকায় তাকে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। মেঝেতে বিছানোর জন্য একটি ম্যাট্রেস পেতে তাকে ১০০ টাকা ওয়ার্ডবয়কে দিতে হয়েছে। ডাক্তার তাকে দেখে ওষুধ ও টেস্ট লিখে দিয়ে যান। তার সাথে আসা বড় বোন মাসুদা পারভীন বাইরে থেকে দুই হাজার টাকার ওষুধ ছাড়াও স্যালাইন এবং দুইটি ইনজেকশন কিনে দেন। মাসুদের টেস্টগুলো সম্পন্ন করে তার বোন বাড়ি ফিরে যাওয়ায় তিনি একা হয়ে পড়েন। টেস্ট রিপোর্টগুলো এনে দিতে ওয়ার্ডবয় তার কাছ থেকে আরো ১০০ টাকা নেন। আবার খালি হওয়া একটি বেড পেতে ওয়ার্ডবয় তার কাছ থেকে ৪০০ টাকা দাবী করায় তিনি মেঝেতেই রয়েছেন বলে জানান।

তিনি সেখানে চরম অব্যবস্থাপনা এবং নোংরা পরিবেশের জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

শিশু ওয়াডসহ অন্যান্য সকল ওয়ার্ডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা রোগী এবং তাদের স্বজনরা কমবেশী প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেন। তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি এই হাসপাতালটির আমূল সংস্কার, প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবল নিয়োগ এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সুনিশ্চিতকরণের পাশাপাশি হাসপাতালের সুবিশাল বহিরাঙ্গনকে ফুলের বাগানে রূপান্তর করার পরামর্শ দেন। 

এদিকে রমেক হাসপাতালের সার্বিক চিত্র নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে উপ-পরিচালক ডা: মো. আখতারুজ্জামান বাসসকে জানান, বিরাজমান সকল সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। সীমিত জনবল দিয়েই বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবাসহ হাসপাতালের সকল কার্যক্রম চালিয়ে নিতে হচ্ছে। 

তিনি বলেন, এক হাজার বেডের হাসপাতাল হলেও রংপুর বিভাগ ও পার্শ্ববর্তী অন্যান্য এলাকা থেকে প্রতিদিন জরুরি বিভাগে আটশ’ থেকে এক হাজার নতুন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন এবং হাসপাতালে ভর্তি হন। 

এছাড়াও প্রতিদিন আউটডোরে গড়ে প্রায় তিন হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করেন। আউটডোরের জন্য আলাদা কোনো ওষুধ বরাদ্দ না থাকায় ইনডোরের বরাদ্দ থেকেই যতটা সম্ভব রোগীদের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করা হয়। 

তিনি বলেন, এক হাজার বেডের বিপরীেেত হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী ভর্তি থাকায় বহু সংখ্যক রোগীকে মেঝেতে থাকতে হয়। 

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি রমেক হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশিকুর রহমানকে নিয়োগ দিয়েছে। এতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিন্ডিেিকট নির্মূলসহ সার্বিক পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে হাসপাতালের চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আশা করছেন।