বাসস
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:২০

কার্যকর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একাধিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে

।। মলয় কুমার দত্ত ।।
ঢাকা, ১৫ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : শিক্ষার্থীদের নেতৃেত্ব গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার শাসনের পতনের প্রেক্ষিতে গত ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম ১০০ দিনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ খাতে বাস্তবসম্মত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। 

দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সরকার বৈষম্যমুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেশ গড়ার লক্ষ্যে জুলাই আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের সেবার লক্ষ্যে সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম গতিশীল এবং প্রাতিষ্ঠানিক কর্মতৎপরতা জোরদার করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।

প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যেকোনো প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় তার সামগ্রিক সক্ষমতা জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়েছে। মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ১৭টি জেলায় বেশ কয়েকটি ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করেছে।
 
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক বাসসকে বলেন, ‘সরকার বন্যার সময় প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এখন মন্ত্রণালয় বন্যা দুর্গতদের পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’ 

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামতের জন্য ১৮০০ বান্ডিল ঢেউ টিন এবং ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে।

দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় গত ৭ নভেম্বর পর্যন্ত প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিদের দান করা মোট প্রায় ৯৭.১৮ কোটি টাকা পেয়েছে।

মোট ১৭টি জেলা- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর ও নেত্রকোনা কয়েক দফায় আগস্টে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। 

কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার ও মৌলভীবাজার জেলায় বন্যায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ৫০ লাখের বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এছোড়া, গত ১৯ আগস্ট উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পাশাপাশি এই অঞ্চলে মুষলধারে বৃষ্টির কারণে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ২০ আগস্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন।

তিনি ২২-২৪ আগস্ট কুমিল্লা ও ফেনী এবং ৩০ আগস্ট থেকে ০১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন।

দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যার সময় পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

এ সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক মেডিকেল টিম বন্যার্তদের চিকিৎসার জন্য কাজ করেছে এবং খাবার পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, কাপড়, ওষুধ, শিশুর খাবার ও স্যানিটারি সামগ্রী বিতরণ করা হয়।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বন্যার সময় উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালায়। এ লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় সার্বক্ষণিক তথ্য দেওয়ার জন্য কন্ট্রোল রুম খুলেছিল।

আগস্ট মাসে দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলা ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করেছে। ফেনী ও নোয়াখালী জেলার অনেক বয়স্ক মানুষ বলেছেন যে, তারা তাদের জীবনে কখনও এমন আকস্মিক বন্যা দেখেননি।

বন্যা সমগ্র পূর্বাঞ্চলে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে যার ফলে ৭০ জনেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে। এ সময় ৫০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং অর্ধ মিলিয়ন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্র এবং স্কুল ও কলেজের বহুতল ভবনে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। 

এতে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের ২৩টি জেলায় ৩৩.৪৬ বিলিয়ন টাকার কৃষির ক্ষতি হয়েছে। সরকারী তথ্য অনুসারে ২০০,০০০ হেক্টরেরও বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৩৭২,৭৩৩ হেক্টর জমি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংকটকালীন সময়ে দেশে একটি অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য দেখা গেছে। এ সময় বৈষম্যমুক্ত ছাত্র আন্দোলনকারীদের ডাকে সাড়া দিয়ে সকল স্তরের মানুষ ত্রাণসামগ্রী এবং নগদ অর্থ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্রে (টিএসসি) ভিড় করে বন্যা দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বৈষম্যমুক্ত ছাত্র আন্দোলন জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটায়।

টিএসসিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে তাদের অনুদান জমা দেওয়ার জন্য বিশাল সংখ্যক লোককে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় সংগৃহীত অর্থ ও ত্রাণ সামগ্রী বন্যা কবলিত এলাকায় বিতরণ করা হয়েছে।

টিএসসিতে সংগৃহীত অনুদানের একটি বড় অংশ পরে বন্যা দুর্গতদের পুনর্বাসন কর্মসূচির জন্য প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে প্রদান করা হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬ আগস্ট থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের ৪৩টি জেলায় বন্যার্তদের জন্য ৪.৭৫ কোটি টাকা (নগদ) এবং ৩৭,৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ করেছে।
এছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে ত্রাণ প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে মন্ত্রণালয় শিশু খাদ্যের জন্য ২.৯০ কোটি টাকা এবং পশুখাদ্য কেনার জন্য ২.৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।

জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর প্রতিনিধি, ইউএনএইচসিআর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার, বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর, অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার উপদেষ্টার সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বন্যা পরিস্থিতি ও পুনর্বাসন এবং অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা করেন।

উপদেষ্টা গত ৭ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের বন্যা কবলিত জেলা পরিদর্শন করেন এবং জেলা প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি বন্যা দুর্গতদের সর্বোচ্চ সহায়তার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন।

তিনি ২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির সভায় বন্যার্তদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।

এই সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের ৬৪টি জেলায় ১৬,৮৩১ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ ও বিতরণ করা হয়েছিল।

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ১০টি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাইরে ২টিসহ মোট ১২টি প্রকল্প দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে।

গত সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দুর্যোগ উদ্ধার অভিযানে ব্যবহারের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগকে ৩৮ মিটার, ৫৮ মিটার এবং ৬৪ মিটার উচ্চতার মই সরবরাহ করে।