শিরোনাম
ঢাকা, ১৯ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস): রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন, হত্যা, গুম-নির্যাতনমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ চাই। যেখানে ভয়-ভীতি থাকবে না। থাকবে সমতা ভিত্তিক ন্যায়বিচার। গড়ে উঠবে ‘হ্যাপি বাংলাদেশ’।
আজ মঙ্গলবার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে ‘কি চাই নতুন বাংলাদেশে?’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে বেনারনিউজ। এটি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে বাংলাসহ পাঁচটি ভাষায় প্রকাশিত একটি গণমাধ্যম।
আলোচনা সভার প্রথম পর্বে কথা বলেন গবেষক ও লেখক ড. মোবাশ্বের হাসান। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ৪৪ দিন গুম করে রাখে। ভাগ্যক্রমে মুক্ত হয়ে জীবন ফিরে পান তিনি।
তিনি বলেন, হাজারো মানুষের রক্তে অর্জিত এই স্বাধীন বাংলাদেশে আর কোন গুম, হত্যা দেখতে চাই না। নতুন বাংলাদেশ হবে গুম, হত্যা অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডমুক্ত, যেখানে মানবিকতা থাকবে রাষ্ট্রের পরতে পরতে।
মূল আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা এমন একটি দেশ চাই যেখানে ভয়-ভীতি থাকবে না। সবার ভয়েস শোনা হবে। ছেলে-মেয়েদের দেশ ত্যাগের তাড়না থাকবে না। থাকবে না কোন পল্যুইশান। গর্বের দেশ হবে।
যাদের হাতে এখনও রক্ত লেগে আছে তাদের বিচার আগে হতে হবে-উল্লেখ করে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে দেশে আনা হবে, বিচার করা হবে। এদের মধ্যে এখনও কোন অনুশোচনা নেই। তাদের জাস্টিফাই করার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, নতুন রাষ্ট্র মেরামত করতে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেও সমর্থন
রয়েছে।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে গণমাধ্যমের ভূমিকার সমালোচনা করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, তখন গণভবন থেকে মিডিয়া নিয়ন্ত্রিত হতো। শহিদ আবু সাইদের হত্যার পর আমরা যখন সিদ্ধান্ত নিই, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে কোন আলোচনা হবে না, ডিজিএফআই চাপ দিলেও আমরা কোনভাবেই তখন আলোচনায় বসতে রাজি হইনি। আমরা আন্দোলন প্রত্যাহার না করার ব্যাপারে অনঢ় ছিলাম। কিন্তু মিডিয়া ঠিকই ফ্যাসিস্ট সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী প্রত্যাহারের সংবাদ প্রচার করে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দালালির বিনিময়ে পূর্বাচলের প্লট পাওয়া সেই সাংবাদিকতা আমরা চাই না। নতুন বাংলাদেশে আমরা চাই গণভবনমুখী মিডিয়া নয়, জনমুখী মিডিয়া চাই। জনগণের প্রত্যাশাকে তুলে ধরবে মিডিয়া। তোষণ সাংবাদিকতা বাদ দিতে হবে, তবেই সব সময় প্রাসঙ্গিক থাকবে মিডিয়া।
গত ১৬ বছরে হওয়া গুম-খুনের বিচার দাবি করেন মায়ের ডাক সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি। তিনি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিভ সিস্টেমের মধ্যে আনতে হবে। আর প্রতিটি হত্যার বিচার আগে করতে হবে। আওয়ামী লীগ আবার রাজনীতিতে আসবে কি আসবে না তার আগে তাদের বিচার আগে করতে হবে।
অভিনয় শিল্পী কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, স্বাধীন দেশে আমরা আনন্দের সাথে সবাই থাকতে চাই। বাবা-মা, অভিভাবকদের জেন-জির মুখের ভাষা বুঝতে হবে। রাষ্ট্রকে তার নাগরিকের তথা তরুণ প্রজন্মের চাহিদা বুঝতে হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা ড. মাহদী আমিন বলেন, স্বাধীন দেশে সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা থাকতে হবে। কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল করতে হবে না- ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। আইনের শাসন থাকবে, বাক স্বাধীনতা থাকবে, এক কথায় আমরা মানবিক বাংলাদেশ চাই। আর গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে নির্বাচিত সরকারের প্রত্যাশা।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে বিএনপি নেতা-কর্মীরা আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের হত্যা, গুম, নির্যাতন-মামলার শিকার হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সব দিক থেকেই আত্মত্যাগকারী দল বিএনপি। ফ্যাসিস্টদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, সংস্কার প্রস্তাব সবার আগে নিয়ে আসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় তিনি সংস্কারের পাশাপাশি সরকারকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের উপর গুরুত্ব দেন।
অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান বলেন, নতুন বাংলাদেশে আমরা সাম্য, মর্যাদা ও সমতাভিত্তিক ন্যায়বিচার চাই। কোন নির্যাতন চাই না। বৈষম্য চাই না। আর কোন গুম, খুন ও ক্রসফায়ার চাই না। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে। ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে চলতে হবে রাষ্ট্রকে। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করতে হবে।
আমেরিকানদের প্ররোচনায় আমরা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেও ফ্যাসিস্ট সরকার গত ১৬ বছরে তা লঙ্ঘন করেছে। আমাদেরকে অন্ধ দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ জাহিদ হোসেনের পিতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তার ছেলের মৃত্যুর পর তার লাশ ও দাফন নিয়েও ফ্যাসিস্টরা অনেক কষ্ট দিয়েছে। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে আর যেন ফ্যাসিবাদী আসতে না পারে। তিনি বলেন, দেশের জন্য এক ছেলে জীবন দিয়েছে, প্রয়োজনে আরেকটি দিবে, এরপরও প্রয়োজন হলে আমি বাবা হিসেবেও জীবন দিতে প্রস্তুত।
এ সময় হাসনাত আবদুল্লাহ শহিদ জাহিদের বাবার কথার রেশ টেনে বলেন, এটাই হচ্ছে আমাদের মূল স্পিরিট, অথচ ব্যাকডোর দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হবে, তাদের বিজনেস পার্টনার বানানো হচ্ছে। আমরা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের বিষয়টিকে নিয়ে সন্দেহের চোখে দেখছি। শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টকেই আমরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিদায় করেছি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিষয়ে কোন আলোচনার সুযোগ নেই। আগে তাদের বিচার নিশ্চিত করা হবে, তা যত বছরই লাগুক।
হাসনাত এ সময় আরও বলেন, জুলাই আন্দোলনের শহীদ পরিবারের প্রতি সহযোগিতা ও আহতদের পুনর্বাসন প্রয়োজন অনুযায়ী তুলনামূলক কম হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে জুলাই ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও রয়েছে। তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর বিপ্লবী সরকার হওয়ার কথা থাকলেও আমরা মুরব্বীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি।
হাসনাত আরও বলেন, একটি ভোটের জন্য এই গণঅভ্যূত্থান হয়নি। এই সরকারের ম্যান্ডেট গণঅভ্যূত্থান। বেসিক সংস্কারগুলো আগে আনতে হবে। সংস্কার ও নির্বাচন সমানভাবে চলবে। বিদ্যমান প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন রেখে নির্বাচন হবে না। রাষ্ট্র কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। অতীতে আমরা নির্বাচিত সরকার দেখেছি। তাদের কাছ থেকে আমরা প্রতারিত হয়েছি। তারা যাতে আর ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য সংস্কার প্রয়োজন।
কথা বলেন শহিদ গোলাম নাফিজের মা নাজমা আক্তার নাসিমা। তিনি বলেন, ছেলে বলতো-দেশের যদি কোন পরিবর্তন না হয় তবে ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। পরিবর্তন এসেছে, জুলাই-আগস্ট যারা নিহত হয়েছেন এখন এসব হত্যার বিচার করতে হবে।
তিনটি পর্বে আলোচনা সভায় উপস্থাপনা করেন বেনারনিউজের সিনিয়র কন্টেন্ট ম্যানেজার আশীফ এন্তাজ রবি, সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ ফয়েজ এবং জেসমিন পাপড়ি। এ সময় প্রথম পর্বে আলোচনায় অংশ নেন ব্যানারনিউজের সাংবাদিক শরীফ খিয়াম, জীবন আহমেদ ও সুদীপ্ত সালাম।
বেনারনিউজ সম্পর্কে এর হেড অব নিউজ শরীফুজ্জামান পিন্টু বলেন, ব্যানারনিউজ বিগত ৪ বছর সরকারের রোষানলে পড়ে বন্ধ ছিল। ৫ আগস্টের পর আবার চালু হয়। মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোই ছিল আমাদের অপরাধ।