শিরোনাম
/ খায়রুল বাশার বুলবুল /
বরগুনা, ২১ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস):জেলায় চিকিৎসা সেবার প্রধান প্রতিষ্ঠান ২৫০ শয্যার বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল। জেলার ১২ লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসা নিতে আসলেও হাসপাতালটি নানা সমস্যায় জর্জরিত।
এখানে চিকিৎসক, জনবলসহ নানা সংকট স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যাহত করছে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালটি ১০০ শয্যা থেকে উন্নীত করে ২৫০ শয্যা করা হলেও বাড়েনি অবকাঠামো অথবা জনবল। এখানে নেই মেডিসিন, সার্জারি ও কার্ডিওলজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের চিকিৎসক। বর্তমানে এই হাসপাতালের জনবল সংখ্যা প্রয়োজনের এক-চতুর্থাংশ মাত্র। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জন্য ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা, ভর্তি রোগী ও বহির্বিভাগ সামাল দেয়া দুরুহ হয়ে গেছে।
তবে এতোসব সংকটের মধ্যেও এই হাসপাতালে একটি যুগোপযোগি সিস্টেম চালু রয়েছে, - ডিজিটাল অটোমেশন সিস্টেম। এতে বেড়েছে হাসপাতালে রাজস্ব আয়, বন্ধ হয়েছে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কীটের অপব্যবহার।
হাসপাতালের তথ্য অনুসারে, এখানে ১০জন সিনিয়র কনসালট্যান্টের মধ্যে রয়েছে ১জন, ১১ জন জুনিয়র কনসালট্যান্টের মধ্যে ৪জন এবং ২৮ জন মেডিকেল অফিসারের পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৫জন। এ ছাড়া নার্সসহ একাধিক পদে রয়েছে ভয়াবহ জনবল সংকট। স্বল্প সংখ্যক জনবল নিয়ে রোগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। যথাযথ সেবা না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে রোগীদের।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শয্যা আর পথ্য ছাড়া কিছু বাড়েনি। জনবলকাঠামো ও অবকাঠামো আগের মতো রেখেই ২০১০ সালে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার সরকারি ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর এখানে ৬তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন ভবনটির উদ্বোধন হলেও ২৫০ শয্যা হাসপাতালে জনবল সংকট ও অবকাঠামো সংকট কাটেনি।
হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগী ভর্তি থাকেন। বহিঃর্বিভাগে গড়ে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়। এরপর প্রশাসনিক কাজ, ময়নাতদন্ত, ধর্ষণের পরীক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এই ১১ জনকেই করতে হয়। এতো রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া একরকম অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
রোগীরা অভিযোগ করেন, অতিরিক্ত রোগী থাকায় যে পরিমাণ সিট থাকার প্রয়োজন তা হাসপাতালে নেই। যে পরিমাণ রোগী সে তুলনায় নার্সের সংখ্যাও কম। এ কারণে তারা সকল রোগীর কাছে আসতেও পারেন না, রোগীদের যেতে হয় তাদের কাছে। এতে অনেক সময় কখন কার কোন ওষুধ প্রয়োজন তা ঠিকভাবে জানেন না তারা।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার ভোগান্তির বেশিভাগ পোহাতে হয় শিশুদের। হাসপাতালে শিশুদের জন্য নির্ধারিত বেড সংখ্যা ৫০টি। এখানে রোগীর সংখ্যা নির্ধারিত বেডের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি থাকে। ভর্তি হওয়া শিশু রোগীদের অনেককেই চিকিৎসা সেবা পেতে বাধ্য হয়ে স্থান নিতে হয় হাসপাতালের অপরিচ্ছন্ন মেঝে, বারান্দাসহ সিঁড়ি ও লিফটের দরজার পাশে। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসা সেবা দিতে সমস্য হচ্ছে চিকিৎসকদের, তেমনি নানা ধরনের পরিবেশগত স্বাস্থ্য ঝুঁকিও থেকে যাচ্ছে,জানালেন অভিভাবক ও চিকিৎসকরা।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. তাজকিয়া সিদ্দিকাহ জানান, জনবল সংকট এবং প্রযয়োজনীয় বরাদ্দের অভাব, নানা সংকটের মধ্য দিয়েও আমরা সর্বোচ্চ সেবার চেষ্টা করছি। অপরিচ্ছন্নতার বিষয়ে তিনি জানান, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর অভাবের পাশাপাশি তাদের বেতনভাতা প্রদান নিয়ে জটিলতা থাকায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
হাসপাতালে চলমান ডিজিটাল অটোমেশন সিস্টেম বিষয়ে সিনিয়র টেকনোলজিস্ট সুভাষ দত্ত জানালেন, কম্পিউটরের মাধ্যমে আগেই জানতে পারি কী ধরনের রোগী আসছে, তার কী কী টেস্ট প্রয়োজন। অটোমেশন সিস্টেম চালুর পর এ হাসপাতালে রাজস্ব আয় বেড়েছে দ্বিগুণ। ২০২২ সালে ৩৬ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ের বিপরীতে ২০২৩ সালে আয় হয়েছে ৬৯ লাখ টাকা। এছাড়াও সার্ভারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টসহ হাসপাতাল থেকে ওুষধ নেয়ার তথ্যও। এতে বন্ধ হয়েছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কীট ও ওষুধের অপব্যবহার। হাসপাতালের পরিসংখ্যানবিদ আল আমিন জানিয়েছেন, হাসপাতালের সমস্ত ডাটা আমাদের লাইভ সার্ভারে যুক্ত থাকে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইলেই মনিটরিং করতে পারেন। রোগীদের হেলথ আইডি সম্বলিত হেলথ কার্ড প্রদান প্রক্রিয়ার ৮০ ভাগ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছে বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল।
জেলা স্বাস্থ্য অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু জানিয়েছেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালের দুই-তৃতীয়াংশ জনবল নেই। এটা নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর জনবল নিয়োগ নিয়ে টানাটানি করছে। এই জটিলতা নিরসন, -আমাদের দাবি।
২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম নজমূল আহসান জানান, ১০০ শয্যা থেকে উন্নীত করে ২৫০ শয্যা করা হলেও বাড়েনি অবকাঠামো অথবা জনবল। ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে সেবা দেবার চেষ্টা করছি। আমাদের কর্মীরা কঠোর পরিশ্রম করে রোগীদের সেবা দিচ্ছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. প্রদীপ চন্দ্র মন্ডল বলেন, ২৫০ শয্যার নতুন ভবনটি চালু হলে সেবারমান অনেক বৃদ্ধি পাবে। হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা চালুর জন্য দরকার ৫৫ জন চিকিৎসক, ১০১ জন নার্সসহ মোট ২৩৩ জনের জনবল। এর মধ্যে ১০৩ জনের পদ শূন্য। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেলা সদর হাসপাাতালের ভবনটি প্রয়োজনীয় জনবল কাঠামো এবং চিকিৎসা যন্ত্র, বেড, অবকাঠামো না থাকার কারণে চালু করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।