শিরোনাম
//মহসীন কবির //
কুমিল্লা, (উত্তর) ২১নভেম্বর,২০২৪(বাসস):জেলার চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল ২০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে প্রধান ফটকে তালা। আশাপাশে কেউ নেই। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দাঁড়োয়ান বিহীন অরক্ষিত পকেট গেটের সন্ধান পাওয়া গেলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই সুনসান নিরবতা। মূল ভবনেও তালা ঝুলানো। ১৯ নভেম্বর দুপুর পৌনে ২টায় এই চিত্র দেখা গেছে হাসপাতালটিতে।
মেলেনি দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর। হাসপাতালটির সামনের দোকানীরা জানান, দুপুর ২টার পর হাসপাতালে কেউ থাকেন না। অথচ বিধি অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টা আবাসিক মেডিকেল অফিসার, নার্স ও অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকার কথা।
অবশ্য টেলিফোনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, বিগত ১৭ বছরে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাই তারা হাসপাতালটির স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছেন না। শুধু তাই নয় তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ না দেয়ায় সেখানে পরিবেশও অপরিচ্ছন্ন। হাসপাতালটির দরজা-জানালা ভেঙ্গে গেছে। আবাসিক ভবনগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার উপক্রম। বিস্তৃত লতাপাতা। সব মিলিয়ে এক ধরনের ভুতুরে অবস্থা বিরাজ করছে দেড় একর জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটিতে।
প্রতিষ্ঠার পর দেড় যুগ ধরেই এমন অচলাবস্থা চলছে বলে জানান, স্থানীয়রা। তাদের অভিযোগ রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার এই হাসপাতালটি। এ কারণে এখন পর্যন্ত চারবার উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু উদ্বোধনের কয়েকদিন পরই আবার একই অবস্থা। মূলত সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ এর প্রতিষ্ঠাতা হওয়ায় এমনটি হচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্ষিয়ান এ নেতা কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের একাধিকবার নির্বাচিত এমপি ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথ্ াহলো তিনি মহিচাইল এলাকারই সন্তান। তাই তার প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কখনও চালু, আবার কখনও বন্ধ রাখা হয়েছে হাসপাতালটি। আর মাঝে মধ্যে সচল থাকলেও ছিলো না প্রয়োজনীয় জনবল ও উপকরণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১ সালে চার দলীয় জোট বিএনপি সরকার গঠনের পর ২০০৪ সালের ১৬ এপ্রিল এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রাথমিকভাবে এর ব্যয় ধরা হয় ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ২০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালটি প্রথমবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও স্থানীয় এমপি ড. রেদোয়ান আহমেদ। শুরুতেই কয়েক মাস মোটামুটি এর কার্যক্রম স্বাভাবিক চলছিলো। তবে ওয়ান ইলেভেনের পর অদৃশ্য কারণে এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ৩০ এপ্রিল তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. আ.ফ.ম রুহুল হক ও কুমিল্লা ৭ (চান্দিনা) আসনের এমপি অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ দ্বিতীয়বারের মতো এর উদ্বোধন করেন। কিন্তু তা উদ্বোধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কয়েক দিন পর তা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই তৃতীয়বারের মতো আবারও উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু তখনও নিয়োগ দেয়া হয়নি প্রয়োজনীয় চিকিৎসক, কর্মকর্তা-
২০ শয্যার হাসপাতাল হলেও রোগীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। কাগজে-কলমে ৬ জন চিকিৎসক থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৩ জন। এর মধ্যে মাঝেমাঝে একজন আসেন। আর আবাসিকভাবে নিয়মিত একজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও তিনি থাকেন জেলা সদরে। আর নার্স চার জন থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র একজন। এসব কারণে ২০১৫ সালের পরও অনেক দিন বন্ধ ছিলো।
২০২১ সালের জুলাইয়ে আওয়ামী লীগের উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হন ডা. প্রান গোপাল দত্ত। তার বাড়িও মহিচাইলে এ হাসপাতালটি সন্নিকটে। স্থানীয়দের অনুরোধে তিনিও এটি চালুর উদ্যোগ নেন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল তার উদ্যোগে চতুর্থবারের মতো ব্যাপক হাক-ডাক করে এটি উদ্বোধন করা হয়। এতে ভিডিও কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালেরই একজন চিকিৎসক জানান চান্দিনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের এ হাসপাতালটির কার্যক্রম স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করলেও দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য রোগীর একমাত্র ঠিকানা ছিলো এটি। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর প্রতিহিংসার কারণে পরিকল্পিতভাবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়। আর তাদের সময়ে তিন দফা উদ্বোধনের বিষয়টিকেও আইওয়াশ বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় হোসেনপুর এলাকার মাওলানা নজরুল ইসলাম বলেন- এ হাসপাতালটি চান্দিনার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য একটি আশীর্বাদ ছিলো। বর্তমানে এটি নামে মাত্র চালু থাকলেও আমাদের কোনো উপকারে আসছে না।
হাসপাতালটির একমাত্র আবাসিক চিকিৎসক মাসুদুল হাসান বলেন, সীমিত জনবল নিয়ে আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি। এর বাইরে আমাদের কিছু করার নেই।
হাসপাতালটিতে প্রয়োজনীয় লোকবল ও অর্থ বরাদ্ধ দেয়া হয়নি। যে কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আরফিুর রহমান বলেন, অচিরেই এটি নতুনরূপে, মূলত রাজনৈতিক কারণে বিগত দিনে ফিরবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন- এই অঞ্চলের পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠীর সুবিধার কথা বিবেচনা করেই এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। কিন্তু আমার সাথে রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধ থাকায় বিগত দিনে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আশপাশের গ্রামের মানুষ। তিনিও হাসপাতালটি পুনরায় প্রাণবন্ত করার দাবি জানান।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. নাছিমা আকতার বলেন, হাসপাতালটি সার্বক্ষণিক খোলা থাকুক এটি আমরাও চাই। তবে এক্ষেত্রে যে অর্গানোগ্রাম দরকার তা আমাদের নেই। তাই আপাতত সীমিত পরিসরে আউটডোর সেবা চালু রয়েছে। প্রয়োজনীয় অর্থ ও জনবল পেলে এখানে ২৪ ঘণ্টায়ই সেবা দেয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।