বাসস
  ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:৩৭
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:০০

বিলুপ্ত ভাড়ারদহ বিল এখন পাখি, মাছ ও কীটপতঙ্গের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে

\ মোঃ মামুন ইসলাম \

রংপুর, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : তিন বছর আগে পুনঃখননের পর, অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক দৃশ্যসহ বিলুপ্ত ভাড়ারদহ বিল এখন অতিথি ও বিলুপ্ত দেশীয় প্রজাতির পাখি, মাছ, প্রাণী ও কীটপতঙ্গের জন্য একটি প্রকৃত অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

সেখানে সুশৃঙ্খলভাবে উড়ন্ত হাজার হাজার অতিথি পাখির কিচিরমিচিরসহ বিলের চারপাশে সৃষ্ট একটি বিশাল সবুজ বন হারানো বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করার পাশাপাশি সকলকে মুগ্ধ করার মতো অবিশ্বাস্য এক নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা করেছে।

রংপুর জেলার বদরগঞ্জ পৌরসভার উপকণ্ঠে চমৎকার পরিবেশ ও অতুলনীয় সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে প্রতিদিন সেখানে সব বয়সের শত শত মানুষ আনন্দ ভ্রমণে যাচ্ছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ‘ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে বৃহত্তম রংপুর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ (ইআইআর)’ প্রকল্পের আওতায় এই বিলটি পুনঃখনন করায় সুন্দর ও মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি হয়েছে। 

বাসসের সাথে আলাপকালে বিলে বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরা জানান, তারা সেখানকার চমৎকার সবুজ পরিবেশ ও বাতাসে সুশৃঙ্খলভাবে উড়ন্ত পরিযায়ী পাখির কিচিরমিচির কলতান, বিলের পানিতে তাদের অবাধ বিচরণ, সেখানে বসবাসকারী প্রাণী ও পোকামাকড়ের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করে অনেক আনন্দিত।

বিলের পার্শ্ববর্তী ফায়ার সার্ভিস পাড়া গ্রামের গৃহবধূ মিনারা খাতুন (৩০) তার ছেলে মিরাজুজ্জামান (৬), গাইবান্ধা থেকে বেড়াতে আসা তার ভাগিনা কুঞ্জ আহসান (১৮) ও আরিয়ান আহসান (১১)-কে  সঙ্গে নিয়ে অনেক দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করা অতুলনীয় স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে সেখানে আসেন। 

তিনি বলেন, বিলের তীরে সৃষ্ট সবুজ ঘনবন, বাতাসে সুশৃঙ্খলভাবে উড়ন্ত পরিযায়ী পাখি, তাদের কিচিরমিচির কলতান ও বিলের পানিতে সাঁতার কাটা স্থানটিতে হৃদয় শীতল করার মতো এক অপরূপ দৃশ্য তৈরি করেছে।

মিনারা বলেন, ‘এখানে আসার পর স্বর্গীয় সৌন্দর্য দেখে আমার মন আর বাড়ি ফিরতে চায় না।’

তার ভাগ্নে কলেজ ছাত্র কুঞ্জ আহসান বলেন, ভাড়ারদহ বিলের পুনঃখনন এবং এর তীরে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির কাঠ, ফল, ঔষধি ও ফুলের চারা রোপণের ফলে সেখানে এক চমৎকার দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে।

কুঞ্জ আরো বলেন, ‘আমি এখানে এ সবকিছুর সৌন্দর্য উপভোগ করছি। যার মধ্যে অতিথি পাখির কিচিরমিচির, একটি নয়নাভিরাম বোটানিক্যাল গার্ডেন-এর মতো সবুজ প্রকৃতি এবং অঙ্কুরিত ও ফুটন্ত রং-বেরংয়ের ফুল রয়েছে।’

নীলফামারীর দম্পতি মহিবুর রহমান (৩৩) ও ফরিদা রহমান (২৮)। তারা তাদের পুত্র মাহবুব (৭) ও মেয়ে মারিয়া (৫)-কে সঙ্গে নিয়ে প্রাকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঐ বিলে এসেছেন।

ফরিদা বলেন, ভাড়ারদহ বিলে অতিথি পাখির কিচিরমিচির কলতান শোনার পাশাপাশি আশেপাশের তীরে বিরল প্রজাতির গাছপালার দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া খুব কঠিন।

বদরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের স্কুল ছাত্র রফিক (১৪), হারুন (১৫) ও আরমান (১৩) জানান, তারা অতিথি ও স্থানীয় পাখি, ফুল ও বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রা প্রাণী ও পোকামাকড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রায়ই পুনঃখনন করা বিলে আসেন।

বিলের দেখাশুনার দায়িত্বে থাকা ৪৫ বছর বয়সী আতিয়ার রহমান জানান, তিন বছর আগে ভাড়ারদহ বিলের পুনঃখনন এবং এর একশ’ ফিট প্রশস্ত তীরে ২১৩টি বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির সাড়ে তিন হাজার কাঠ, ফল, ঔষধি ও ফুল গাছের চারা লাগানোর ফলে এখন এক অবিশ্বাস্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে।

বিলটির পাড়ে ও গাছ-গাছালিতে বাস করা কীটপতঙ্গ, ফড়িং, প্রজাপতি, মৌমাছি, কেঁচো,  গিরিগিটি, টিকটিকি, ভিমরুল, সাপ, ব্যাঙ, বন পিপড়া, বেজি, গুইসাপ, শিয়াল, ইঁদুর, খরগোশ, ডাশ মশা, গোবরে পোকা, ঝিঁঝিঁ  পোকা ও জোনাকিসহ বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। 

মহিবুর বলেন, শতশত মানুষ বিলটিকে ঘিরে সবুজের সমারোহ, অতিথি পাখির কিচিরমিচির, ফুটন্ত ফুল এবং অভাবনীয় ও মনোরম সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন সেখানে ভিড় করছেন ।

বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও রিভারাইন পিপল-এর পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বাসসকে বলেন, ভাড়ারদহ বিল পুনঃখননের ফলে এখন স্থানীয় প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ, প্রাণী, মাছ, স্থানীয় ও অতিথি পাখি, পোকামাকড় ও প্রাণীর জন্য এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, পুনরায় খনন করা বিলটি এমন সময়ে বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করে চলেছে, যখন জলবায়ু পরিবর্তনের রিরূপ প্রভাবে জলাশয়গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় দেশীয় প্রজাতির পাখি, ছোট মাছ, পোকামাকড়, ছোট শামুক, শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ ও অন্যান্য কাণ্ডহীন জলজউদ্ভিদ ও অনেক প্রাণীর অস্তিত্মত্বকে হুমকির মুখে ফেলছে। 

তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিলটি কোনও ব্যক্তিগত সংস্থা বা কোন ব্যক্তিকে যেন ইজারা দেওয়া না হয়। বাস্তুতন্ত্রের আরও উন্নতির জন্য সেখানকার গাছপালা ও জীবন্ত প্রাণীর সম্পূর্ণ সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এটিকে একটি ইকো-পার্ক কাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিণত করা উচিত।

মৎস্য চাষের নামে স্থানীয় লোভী ব্যক্তিদের কাছে জলাশয়টি ইজারা দেওয়া বা সেখানে পর্যটন স্পট স্থাপন করা হলে পুনঃখননকৃত ভাড়ারদহ বিলের ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ বিঘ্নিত হতে পারে বলে তিনি আশংকা করেন।

ইআইআর প্রকল্পের পরিচালক ও রংপুর সার্কেলের বিএমডিএ সুপারিনটেনডিং ইঞ্জিনিয়ার মো. হাবিবুর রহমান খান বলেন, পুনঃখনন করা ভাড়ারদহ বিলে এখন শত শত মানুষ চারিদিকে সবুজের সমারোহ, অতিথি পাখির কিচিরমিচির কলতান ও নানা ভঙ্গিমায় বাতাসে তাদের উড়ন্ত চলাচলের অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করছেন।

তিনি বলেন, ২০১৯-২০২৫ মেয়াদি প্রকল্পটির লক্ষ্য হল- সংরক্ষিত ভূ-পৃষ্ঠের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও জীবিকাকে উন্নীত করা, বনায়ন ও বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ, পাখি, কীটপতঙ্গ ও প্রাণীদের জন্য বাস্তুতন্ত্র ও অভয়ারণ্যগুলিকে পুনরুজ্জীবিত ও সুরক্ষিতকরণ।