শিরোনাম
॥ আল-আমিন শাহরিয়ার ॥
ভোলা, ৩০ নভেম্বর, ২০২৪, (বাসস) : এ জেলার মানুষ বন্যা,জলোচ্ছ্বাস আর প্রাকৃতিক দুূর্যোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছেন। দেশের অন্যান্য জেলাগুলো যে মূহুর্তে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে, সে সময়ে জোয়ার ভাটার শ্রমে হারিয়ে যায় শিশুদের শিক্ষাজীবন। জেলা সদর কিম্বা উপজেলা সদরেরগু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে কোনোরকম জোড়াতালির পড়ালেখা চললেও চরাঞ্চলের অজোপাড়ায় শিক্ষার আলো জ্বলছেনা বললেই চলে। বিশেষ করে এখানকার শিশুরা স্কুল বিমুখ হয়ে পরিবারের উন্নতির আশায় খাল,নদী আর সাগরে মাছ ধরতে নেমে পড়ে। আবার শিশুদের আরেকটি অংশ জীবিকার তাগিদে কৃষিকাজে মত্ত্ব হয়ে পড়ে। কোমলমতি এসব শিশুর হাতে যেসময় থাকার কথা বই,খাতা আর রং পেনসিল, তখন তাদের কাঁধে বইতে হয় সংসারের বোঝা। কার্যত শিশুশ্রমের বেড়াজালে কাটছে উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো শিশুর জীবন। উপকূলীয় জেলা ভোলাসহ এতদাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার জেলে পরিবারের অসংখ্য শিশুর দিন কাটে কঠিন শ্রমের কঠোর যাতাকলে। অবহেলা আর অনাদরে বেড়ে উঠা এসব শিশুদের আনন্দ-বিনোদন তো দূরের কথা, সুষম খাবার আর প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ পর্যন্ত তাদের ভাগ্যে জোটেনা।
শ্রমের কষাঘাতে পিষ্ট এসব শিশুদের জীবন সংগ্রামের ভয়াল চিত্র অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে,তাদের নিদারুন কষ্টের গল্প।
ভোলা শহরতলীর ধনিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলির মেঘনা পাড়ের মাছঘাটে গিয়ে কথা হয় শিশু শ্রমিক মমিনের সঙ্গে ।মমিনকে যে বয়সে বাবা-মা আদর যত্ম করে স্কুলে পাঠানোর কথা, বাবা-মায়ের আদর স্নেহে বেড়ে উঠার কথা,সেই বয়সে শিশু মমিনের হাতে ধরতে হয়েছে সংসারের চাকা। অভাবের সংসার,তাই ১১ বছর বয়সেই শিশু মমিন এখন দায়িত্বশীল একজন। মমিন জানায়,রোজগার না করলে তাদের চুলায় আগুন জ্বলবে না। মমিন ওই ইউনিয়নের বাসিন্দা মোশারফ ও রহিমা দম্পতির ছেলে। ৩ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে মমিন দ্বিতীয়।
একই এলাকার জেলে পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, মমিনের সঙ্গীয় আরো কতেক শিশু জাল বুনছে। এর মধ্যে নজর পড়ে ১০/১১ বছরের অপর এক শিশুর দিকে।
রৌদ্রে কালো হয়ে গেছে তার শরীর। তাদেরই একজন মমিন, সে ছেড়া জালের ঝালাই সারতে সুতার কাজ করছে।
স্কুলে যাও কিনা জানতে চাইলে, সে জানায়, ভাতই খাইতে পারি না, স্কুলে যামু কেমনে। তবে পড়ালেখা করতাম চাই, পারি না। কেমন আয় হয় তোমার ? বড়রা যা পায়, আমি তার থেকে একটু কম পাই। ৩/৪শ' টাকা পাই, আবার কমও পাই।
মেঘনা পাড়ের ইলিশা তেমাথা ঘাটের কাছেই বাবার মাছ ধরার সঙ্গী হিসেবে ছিলেন ১০ বছরের শিশু হাসিব। হাসিবের ভাষ্য,‘স্কুলে যাইতে তো ইচ্ছা করে তয় কামের লাইগ্যা যাইতে পারি না। জোয়ার আওয়ার আগেই জাল পাতি, আর ভাটায় পানি টানলে মাছ লইয়া আইতে আইতে স্কুল ছুটি হইয়া যায়।
এ ঘাটেই কথা হয় আরো কিছু জেলে শিশুর সঙ্গে। মনির, আব্বাস ও রুবেল নামের এ শিশুরাও বলছে, বাবার কাজের সঙ্গী হতে হয় বলেই তারা স্কুলে যেতে পারে না। দৌলতখান উপজেলার মেঘনা মধ্যবর্তী মদনপুর চরে গিয়ে সেখানকার জেলে রফিক,সালেম,কাশেম ও রফিজল মাঝির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, মাছ ধরা আমাদের বাপ-দাদার পেশা। এ পেশাকে ধইরা রাখছি এখনো। আমাদের সন্তানরা সেই পেশা ধইর রাখবো।
ছেলে বেলা থেকে কাজ শিখলে বড় হয়ে একজন দক্ষ মাঝি হিসেবে নিজেদের গড়তে পারবে ওরা। রাজাপুর চরের জেলে ইউসুফ (৪৫) বলেন, সব পরিবারই এখন বোঝে যে, তাদের পোলাপাইনগুলারে পড়ানো উচিৎ। কিন্তু পেটের তাগিদে সবাই তো পড়াইতে পারে না। ভোলার খালের মাছ ব্যবসায়ী আরিফ জানান, নৌকায় একজন জেলের পক্ষে জাল টেনে মাছ ধরা কষ্টকর। মাছ ধরতে হলে আরো লোকের দরকার হয়। দরিদ্র জেলেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পরিবারের মানুষগুলোকে সহকারী হিসেবে ব্যবহার করে। মূলত: এ কারণে শিশুগুলোকে স্কুল ছাড়তে হয়। মমিন,হাসিব,রুবেল,আব্বাস আর শিশু মনিরদের মতো এমন অসংখ্য শিশুদের জীবন কাহিনীর দৃশ্য ভোলা উপকূলে মেঘনা নদীর বুকে জেগে উঠা ভোলারচর, মাঝেরচর, মদনপুর চর, চটকিমারা চর, রামদাসপুর এবং মেঘনার কূলের বিভিন্ন বেড়িবাঁধ এলাকার জেলেপাড়ায়। সেখানে হাজার হাজার জেলেদের বসবাস। নদী ভাঙ্গনে দিশেহারা এ জনপদের বসতি ছাড়া আর কিছু নেই। নদীতে মাছ শিকার ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। পৈত্রিক পেশাকে ধরে জীবিকা নির্বাহ করছে হাজার হাজার পরিবার। এসব অঞ্চলে প্রাথমিক বা কিছু জায়গায় মাধ্যমিকের আলো পৌঁছালেও যেন শিক্ষা গ্রহণ না করেই জেলে বা কৃষক হিসেবে গড়ে উঠছে তাদের শিশুরা। দারিদ্র সংসারে একটু আয়ের আশায় এখানকার শিশুরা খুব কম বয়সেই বেছে নিতে বাধ্য হয় জেলে অথবা কৃষি জীবন।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানকালে দেখা যায়, জেলে নৌকায় কাজ করা অধিকাংশের বয়স ৮ থেকে ১৫ বছর। জীবনের প্রয়োজনে তারা এ বয়সে হয়ে ওঠে দক্ষ মাঝি বা জেলে। এ শিশুদের কেউ বাবার সঙ্গে জাল টানে, কেউ নৌকার বৈঠা ধরে, কেউবা জাল থেকে মাছ ছাড়িয়ে ঝুড়িতে তোলে। আকৃতি অনুযায়ী মাছ বাছাই করার কাজও তারা করে। এভাবেই শিশুরা পড়ালেখা রপ্ত না করে দক্ষ জেলেতে পরিণত হওয়ার শিক্ষা নিয়ে থাকে।
সরেজমিন,ভোলার খাল, ইলিশা বেড়িবাঁধ, মাঝেরচর, মদনপুরসহ এসব অঞ্চলের জেলে পরিবারগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রতিনিয়ত অনিশ্চতায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে জেলে পল্লীর হাজারো শিশুর শৈশব। শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন আর বাবার কষ্টের সঙ্গী হতে ষষ্ঠ শ্রেণিতে আর পড়া হয় না অধিকাংশ শিশুর। ফলে কোমলমতি এসব শিশুর কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা।
শিশুদের এমন অগোছালো জীবন মান নিয়ে কাজ করা স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কোষ্ট ট্রাষ্টের সমন্বয়ক ফজলুর রহমান বাসস'কে বলেন,ভোলা উপকুলের চরাঞ্চলের অধিকাংশ শিশু এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তাদের প্রাথমিকের গন্ডি শুরু হয় জাল,জলা,কাস্তে আর উত্তাল নদীতে মাছধরা নৌকার বৈঠা হাতে নেয়। তিনি জানান, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯০ সালের আগস্টে স্বাক্ষর করলেও ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ এ সনদ গ্রহণ করে। আগের তুলনায় শহর এলাকায় শিশুশ্রম কিছুটা কমলেও উপকূলের চরাঞ্চল ও জলেপলীøতে এর মাত্রা অত্যধিক।
এ বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক মো: আজাদ জাহান বাসস'কে বলেন,উপকূলীয় শিশুর শিক্ষা,জীবন মান ও শিশু সুরক্ষা নিয়ে অতীতের চেয়ে এখন আরো বেশী কাজ করছেন তার প্রশাসন। তাছাড়া বর্তমান সরকারও এ জেলার শিশুদের উন্নত জীবন মানের সার্বিক উন্নতিকল্পে নিরলসভাবে নানানভাবে সমন্বিত কাজ চালাচ্ছেন।