বাসস
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৩

বরগুনার গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার

বরগুনা, ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জেলার আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের টেপুরা গ্রামে হযরত গাজী কালু (রঃ)’র মাজার রয়েছে। দূর দূরান্ত  থেকে বিশ্বাসী হাজারো নারী-পুরুষ আসেন জিন্দা পীরের কাছে তাদের মঙ্গল কামনা ও মানত, মনোবাসনা পূরণের জন্য।

মাজারের খাদেম ও প্রবীণ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গাজী কালুর কাহিনীকে তারা ধর্মীয় কাহিনী বলে বিশ্বাস করেন। মাজারে মধ্যে কোন সমাধি আছে কী না, বিষয়টি সকলের কাছে ধোঁয়াশা। মাজারটি কতো পুরোনো তাও তারা সঠিকভাবে বলতে পারেননি।

মাজারের তত্বাবধায়ক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু মল্লিক জানিয়েছেন, প্রতি বছর ২৯ মাঘ ও ২৯ ফাল্গুন এখানে ওরস মাহফিল উপলক্ষে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মিলন মেলা বসে। চলে প্রার্থনা, কবি ও পালা গান। ওরসের দুই দিন ছাড়াও আধ্যাতিক বিশ্বাসের লোকজন সারা বছরই এ মাজারে আসা-যাওয়া করেন।

মধ্যযুগের কবির কল্পনায় আঁকা কাব্যিক চরিত্র গাজী কালু বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে অলৌকিক পীর-দরবেশের স্থানে আসীন রয়েছেন। । মধ্যযুগের কবিরাও ধর্মীয়, পৌরাণিক, লৌকিক বা ঐতিহাসিক ঘটনা বা ব্যক্তিকে উপজীব্য করে এ জাতীয় কাব্য রচনা করতেন। চব্বিশ পরগণা জেলার কবি কৃষ্ণরাম দাস ১৬৮৫/১৬৮৬ সালে বাঘ দেবতা দক্ষিণ রায়কে কেন্দ্র করে ‘রায়মঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন। এ কাব্যে তিনি দক্ষিণরায়ের প্রতিপক্ষ হিসেবে গাজী পীরকে উপস্থাপন করেন। এতে তাদের মধ্যে প্রথমে বিরোধ ও পরে বন্ধুত্ব দেখানো হয়েছে। রংপুরের মুসলিম কবি শেখ খোদা বখশ ১৭৯৮/৯৯ সালে রায়মঙ্গলের এ কাহিনী রূপান্তর করে ‘গাজী কালু ও চম্পাবতী’ নামক কাব্য রচনা করেন। পরে আরো কয়েকজন পদকর্তা একই কাহিনীকে কেন্দ্র করে কাব্য রচনা করেছেন। বিভিন্ন পদকর্তার কাব্যে স্থান, চরিত্র ও কাহিনীর মধ্যে কিছুটা পার্থক্যও লক্ষ্য করা যায়। তবে মূল কাহিনী মোটামুটি এক রকমের।

রৈবাট নগর রাজ্যের বাদশাহ সিকান্দারের পুত্রের নাম ছিল গাজী। কালু ছিল বাদশাহের পোষ্য পুত্রের নাম। আর চম্পাবতী ছিলেন ব্রাহ্মণনগর রাজ্যের রাজা মুকুট রায়ের কন্যা। কাহিনীতে দেখা যায়, গাজী রাজ সিংহাসন ত্যাগ করে কালুকে সঙ্গে নিয়ে ফকির বেশে সুন্দরবনে এসে উপস্থিত হন।পরে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণনগরে উপস্থিত হলে রাজকন্যা চম্পাবতীকে দেখে মুগ্ধ হন। কালুর মাধ্যমে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব  পাঠালে রাজা কালুকে বন্দি করেন। ফলে সঙ্গে রাজার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে  রাজা পরাজিত হন, ইসলাম গ্রহণ করেন এবং চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিয়ে হয় ।এসবের পাশাপাশি কিছু উপকাহিনীও রয়েছে এতে।

বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা, উৎসব বা বিশেষ কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে পেশাদার গায়েনদেরকে ভাড়ায় এনে এসব কাহিনী নির্ভর  পালাগান অনুষ্ঠিত হতো। সে যুগে আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম কম থাকায় বিভিন্ন এলাকার মানুষ দল বেধে তা উপভোগ করতে যেত। এভাবে গাজী কালু ও চম্পাবতীর কাহিনী বাংলার ঘরে ঘরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে গাজী কালু সাধারণ মানুষের মনোজগতে স্থান করে নেয় অলৌকিক পীর হিসেবে।

বাংলার সাধারণ মুসলমান সমাজে গাজী কালু ও চম্পাবতী এখন ধর্মীয় কাহিনী হিসেবে পরিগণিত। যার প্রেক্ষিতে বাংলার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে সুন্দরবন সন্নিহিত জেলাগুলোর অনেক স্থানে গড়ে উঠেছে গাজী কালু ও চম্পাবতীর মাজার। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মাজার হচ্ছে ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড় বাজারে।

বরগুনার বিশিষ্ট ইসলামী শায়খ মাওলানা ওমর ফারুক জানান, গাজী কালু ও চম্পাবতী কাহিনীর সঙ্গে ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন সম্পর্ক নেই। এটা কেবলমাত্র ‘মীথ’।  

বরগুনার আমতলী সরকারি কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন আকন বলেন, না-ই থাকুক ঐতিহাসিক বা ধর্মীয় পটভূমি, হোক গল্পগাঁথা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গাজী কালুর দর্শন তাত্বিক ভিত আমাদের বাঙালি সংস্কৃতিতে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এ মাজারটি বরগুনার একটি ঐতিহ্য।