বাসস
  ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮

আজ ১০ ডিসেম্বর ভোলা মুক্ত দিবস

ভোলা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : আজ ১০ ডিসেম্বর ভোলা পাক হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভোলা পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের ফলে পাকিস্তানী বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনী ভোলা ত্যাগ করে। তাদের চলে যাবার  সঙ্গে সঙ্গে ভোলা পাকহানাদার মুক্ত হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আশপাশ থেকে শহরে প্রবেশ করে শহরের ওয়াপদা পাওয়ার হাউজ এবং পরবর্তীতে জেলা সরকারি বালক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। আজ ভোলা হানাদার মুক্ত দিবস উদযাপন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
ভোলায় ৭০’র প্রলয়ংকারী বন্যা ও ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারী জলোচ্ছ্বাসে ভোলায় কয়েক লাখ লোক মারা যায়। ভেসে যায় মানুষ, গবাদি পশু, ঘর-বাড়ি সহ সবকিছু। অনেকে হারান তাদের প্রিয়জনকে সেই শোক কাটতে না কাটতেই ৭১’র যুদ্ধ শুরু হয়, আর এতেও ভোলার কয়েক হাজার মানুষ মারা যায়।
ভোলায় পাকবাহিনীর আগমন : ভোলা নদী বেষ্টনী হওয়ায় পাকবাহিনী সহজে এখানে আসতে পারেনি। তাদের বড় একটি দল ২মে ভোলা মহকুমার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। তারা কয়েকটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং একটি দল ভোলার বোরহানউদ্দিন হয়ে লালমোহন যেয়ে পৌঁছায়। ৯ মে অপরাহ্নে পাকসেনারা আবার ভোলায় ফিরে আসে, এসময় তারা দুইজন নিরীহ হিন্দু বৃদ্ধকে গুলি করে হত্যা করে।
ওয়াপদা রেস্ট হাউজের বধ্যভূমি : ভোলা পৌর এলাকার চরজংলা মৌজায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রদান কার্যালয় ওয়াপদা কলোনীর পূর্ব পার্শ্বস্থ দেয়াল ঘেঁষে রয়েছে ভোলার প্রধান ও একমাত্র বধ্যভূমি। ৭১’র যুদ্ধের সময় পাক বাহিনী এখানেই তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ওয়াপদা রেস্ট হাউজ থাকায় নানাবিধ সুবিধার কারনে পাক বাহিনী রেস্ট হাউজ দখল করে নিরীহ মানুষের উপর তান্ডবলীলা চালায়। ভোলার সবগুলো থানার  সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তা রেস্ট হাউজ সংলগ্ন হওয়ায় এটিকেই নিরাপদ স্থান মনে করে পাকবাহিনী। তারা এখানে দুটি বাংকার তৈরী করে। ভোলায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জাহান জেব খান। তার নিদেশে রেস্ট হাউজের দক্ষিণ পূর্ব পার্শস্থ দুটি কামরা প্রস্তুত করা হয় নির্যাতনের সেল হিসেবে। এখানে কত মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা কারা হয়েছে তার সঠিক হিসেব দেয়া সম্ভব নয়।
খেয়াঘাটের বধ্যভূমি : পাকবাহিনী ভোলায় আগমনের পর মে থেকে জুনের মধ্যে সর্বত্র তাদের অবাদ বিচরণ ঘটে। খেয়া ঘাট শহরের কাছাকাছি হওয়ায় পাকবাহিনী নির্বিচারে শান্তি প্রিয় ভোলাবাসীদের হত্যাকরে লাশ পানিতে ভাসিয়ে দিত। এখানে শুধু লাশই ফেলা হত না একই  সঙ্গে কয়েক জনকে ধরে এনে লাইনে দাড় করিয়ে গুলিকরে হত্য করেছে পাকবাহিনী। খেয়াঘাটে নিহত কয়েকজনের নাম পরবর্তীতে জানা যায় এরা হচ্ছে- শহীদ জালাল আহম্মেদ, নাসির আহম্মেদ, আজিজল ব্যাপারী, বাবু বিনোদ বিহারী মজুমদার, সরুপ চৌকিদার, রাধা গোবিন্দ ও উপেন্দ্র দাস।
 ভোলার যুদ্ধ : ৭১’র এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে খুব গোপনীয়ভাবে ভোলা শহরের লেকু মিয়ার বাসায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধের বৈঠক বসে। এতে উপস্থিত ব্যক্তিবগ একেক জন একেক দায়িত্ব নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্রসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। তাদের সুদক্ষ নের্তৃত্বে একটি কমান্ড বাহিনী গঠিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভোলা মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ভোলা মহকুমায় বেশ কয়েকটি জায়গায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মূখ যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এর মধ্যে, ওসমানগঞ্জের যুদ্ধ, দেউলার যুদ্ধ, বাংলাবাজার যুদ্ধ, দৌলতখান যুদ্ধ ও ঘুইংগার হাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এসব যুদ্ধে পাকবাহিনীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সেনা সদস্য নিহত হয়।
যাদের হারাল : স্কুল শিক্ষক  মোতাহার মাষ্টার ৭১’র ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার পর তিনি নিজ উদ্যোগে উপজেলার গজারিয়ায় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের স্কুল মাঠে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। একটি শক্তিশালী মুক্তিবাহিনী গঠন করে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। মে মাসে ভোলায় প্রথম পাকবাহিনী প্রবেশ করার সময় গেরিলা কায়দায় তাদের উপর আক্রমণ করেন। তিনি ভোলার বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য সম্মূখ যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৫ সালের দশ জানুয়ারি গজারিয়া বাজারে এক অনুষ্ঠানে আততায়ীর হাতে নিহত হন। 
দানবীর নলিনী দাস : ব্রিটিশ সরকারের অন্যায় আর অত্যাচারের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর নলিনী দাস বার বার কারা বরন করেছেন।  দীর্ঘ ১৩বছর বন্দী জীবন কাটিয়ে ভারত বিভক্তির পর দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের মুক্তযুদ্ধে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এবং ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল : ছোট বেলা থেকেই ডানপিঠে ছিলেন মোস্তফা কামাল। স্বপ্ন ছিল সৈনিক হবেন, কিন্তু এতে বাঁধসাধেন বাবা। একরোখা আর ডানপিঠে স¦ভাবের মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগদেন সেনাবাহিনীতে। প্রথমেই তার পোস্টিং হয় কুমিল্লা সেনানিবাসে। ৭১’র মার্চের মাঝামাঝি ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার পর মেজর শাফায়াত জামিল তার গুটিকয়েক বাঙালী সেনা সদস্য নিয়ে পাক অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল খিজির হায়াত খান ও পাকিস্তানসেনাদের নিরস্ত্র করে বন্দী করেন। আর এ মিশনে অংশগ্রহণ করেন সিপাহী মোস্তফা কামাল। একে একে শুরু হয় প্রতিরোধ। সিপাহী মোস্তফার সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতৎপরতা দেখে মেজর শাফায়াত জামিল তাকে যুদ্ধকালীন সময়ে ল্যান্সনায়েকের দায়িত্ব প্রদান করেন। এতে মোস্তফা কামাল ১০ জন সৈন্যেও সেকশন কমান্ডার হন। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চিহ্নিত করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তরদিকে অগ্রসর হতে থাকে।
১৭ এপ্রিল পাকবাহিনী দরুইন এলাকায় পৌঁছে মুক্তিযোদ্ধাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, এরকম অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের পশ্চাদপদতা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। সবাই পিছু হটলেও আসেনি মোস্তফা কামাল এলএমজি দিয়ে গুলি চালিয়ে পাকবাহিনীকে তটস্থ করে রাখেন। আর এরই মাঝে বাকী মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে স্থান ত্যাগ করেন। পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেলে মোস্তফা কামালকে খুঁজে না পেয়ে পুনরায় দরুইন আসেন মেজর শাফায়াত জামিল ততক্ষণে এলাকাবাসী ট্রেনের কাছে একজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। গায়ে গুলি ও বেয়নেটের দাগ মাটিতে পড়ে আছেন মোস্তফা কামাল। তার আত্মত্যাগের কারনে বেঁচে গেলেন বাকী মুক্তিযোদ্ধারা। এলাকাবাসী সেখানেই তাকে সমাহিত করলেন। তার এ মহান ত্যাগ ও বীরত্বের জন্য পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠের মর্যাদা। আর ভোলাবাসী পেয়েছেন তাদের বীর ও গর্বের প্রতীক ৭জন বীরশ্রেষ্ঠের একজন মোস্তফা কামাল।