বাসস
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭:৩৩

মুক্তিকামী সশস্ত্র বাহিনীই বিজয়ের গতিপথ নির্মাণ করে দিয়েছিল

মো. মানিকুল আজাদ

ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসে বিংশ শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে জয়লাভ করা  বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।

মহান মুক্তিযুদ্ধে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অকুতোভয় বীর সেনানি মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে জল-স্থল ও আকাশপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ চালিয়েছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মাচ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হামলার পর বাঙালি সশ্রস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ মুক্তিযুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করে দেয় এবং পরবর্তীকালে বিজয় অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনবাজি রেখে তারা এমন দুঃসাহসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অবদানকে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যলোচনা করা খুবই দুরূহ। প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতির বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তা সামরিক যুদ্ধ কৌশলের মাপকাঠিতে সত্যিই অনন্য।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালালে প্রথমে একটি প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।

একাত্তরের উত্তাল সময়ে এদেশের মানুষ দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যার-যা-ছিল-তাই নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। কিন্তু সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সৈনিকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, যা পরবর্তী নয় মাস ধরে অব্যাহত থাকে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলায় সক্রিয় নেতৃত্ব দেয় এবং মুক্তিফৌজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা যুদ্ধ কৌশল নির্ধারণ ও পাল্টা আক্রমণেও পালন করেন অনবদ্য ভূমিকা।

সেই সময়কার কথা মনে করে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, বীর বিক্রম সম্প্রতি বাসসকে বলেন, স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেওয়ার সময় তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমানের পাশেই ছিলেন।

‘পটিয়া থানা থেকে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি জিয়াউর রহমানকে রেডিও স্টেশনে যেতে বলি এবং তাকে একটি গার্ডসহ কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে পাঠাই। এটি একটি ট্রান্সমিটিং স্টেশন ছিল, যা কিছুটা পরিবর্তন করে ব্রডকাস্টিং স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে হামলার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের যাত্রা শুরু করে, যা বাঙালি বেসামরিক এবং সামরিক সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলনের সূচনা করে। এটি শুধুমাত্র প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপ ছিল না, বরং এটি ছিল স্বাধীনতার জন্য একটি কৌশলগত যুদ্ধ।

প্রাথমিক প্রতিরোধটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এর বাঙালি সদস্যদের নেতৃত্বে হয়, যারা পাকিস্তানি বাহিনী থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পক্ষত্যাগ করে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনী গঠন করেন।

মুক্তিবাহিনী (যা পক্ষত্যাগ করা বাঙালি সৈনিক, পুলিশ সদস্য এবং সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে গঠিত) পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রধান যুদ্ধশক্তি হয়ে ওঠে। তারা গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী সরকার গঠন করে, যা মুক্তি সংগ্রামকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী গঠনের মাধ্যমে এ যুদ্ধ একটি টার্নিং পয়েন্টে আসে। অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়, যার প্রতিটিতে একজন কমান্ডার নিয়োগ করা হয়, যারা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেন।

এই সেক্টরগুলোর মাধ্যমে একটি গেরিলা কৌশল প্রয়োগ করা হয়, যা পাকিস্তানি বাহিনীর সরবরাহ লাইন ধ্বংস এবং তাদের শক্তিকে অকার্যকর করতে ‘হিট-অ্যান্ড-রান’ আক্রমণের ওপর জোর দেয়। এই পরিকল্পনাটি ‘তেলিয়াপাড়া কৌশল বা সম্মেলন’ নামে পরিচিত।

পরে স্বাধীন ব্রিগেড জেড-ফোর্স, এস-ফোর্স এবং কে-ফোর্স গঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরও জোরদার করা হয়। এই ব্রিগেডগুলো বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত এবং সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত ছিল, যা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অভিযানকে সহায়তা করে।

মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শফিউল্লাহর মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ব্যক্তিবর্গ এই ব্রিগেডগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে কামালপুর, সিলেট ও বেলোনিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোতে বিজয় অর্জন করেন। তাদের প্রচেষ্টা গেরিলা যুদ্ধ ও প্রচলিত সামরিক লড়াইয়ের যৌথ কৌশলের কার্যকারিতা প্রমাণ করে।

মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব শুধুমাত্র একটি সামরিক কার্যক্রমই ছিল না, এটি রাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

ওসমানী এবং সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে স্পষ্ট সামরিক কমান্ডের উপস্থিতি প্রবাসী সরকার গঠনের পথ তৈরি করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়। এই প্রবাসী সরকার আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন ও স্বাধীনতার যুদ্ধকে বৈধতা দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনগণের যুদ্ধ, তবে এটি মূলত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়, যারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং নিশ্চিত বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ একটি সমন্বিত যুদ্ধ নিশ্চিত করে এবং যুদ্ধের বিভিন্ন দল-গোষ্ঠীকে একত্রিত করে একটি একক ও সংগঠিত শক্তি  মুক্তিবাহিনী গঠন করে।

এদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধ নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ গৌরবময় ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশ সশ্রস্ত্র বাহিনীর অধীনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্ম হয়। ৪৯ জন নাবিক নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের শুরু করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ সকল নাবিক শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। পাশাপাশি অপারেশন ‘জ্যাকপট’ নামে নির্ভীক ডুবুরীদল সমুদ্র বন্দরসমূহে বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনা করেন।

মুক্তিযুদ্ধে বিমানবাহিনীর ৩৫ জন অফিসার ও ক্যাডেট এবং প্রায় ৫শ’ বিমান সেনা পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের শেষের দিকে এই বাহিনীর সদস্যরা ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’ শুরু করেন, যার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামী বীর যোদ্ধারা শত্রু পক্ষের উপর হামলা চালিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী সম্মিলিতভাবে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের সূচনা করে। আর তখন থেকে ২১ নভেম্বর সশ্রস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত হয়ে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সশ্রস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যকে সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ৫৮ জনকে বীরউত্তম, ১৩৪ জনকে বীরবিক্রম ও ১৭৮ জনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে এই একাত্মতা শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সামরিক বিজয়ই নিশ্চিত করেনি, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের গুরুত্বপূর্ণ রক্ষক ও নির্মাতা হিসেবে সশ্রস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা নিশ্চিত করেছে।