শিরোনাম
রুমানা জামান
ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : অবসরপ্রাপ্ত মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রম একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ এক সময় ছিলেন সাড়া জাগানো ফুটবলার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন বীর বিক্রম খেতাব। প্রায় ৪০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে সংসদ সদস্য ছিলেন প্রায় ২০ বছর। ছিলেন সফল মন্ত্রীও।
স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে দেশের এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যাশা জনযুদ্ধের মাধ্যমে নতুন স্বাধীনতা পাওয়া এই বাংলাদেশের মূল কাণ্ডারী হবে তরুণ প্রজন্ম। তাদের হাত ধরেই স্বাধীনতার লক্ষ্য, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তি ফিরে আসবে। সাধারণ মানুষ যে কোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতাকে অক্ষণ্ন ও কালিমামুক্ত রাখবে। গড়ে উঠবে এক নতুন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বনানীর বাসায় বসে তিনি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)কে শুনিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অসামান্য বীরত্বগাথা; রণাঙ্গণের গৌরবদীপ্ত গল্প।
ছোটবেলা থেকেই হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন খেলা পাগল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের সময়ই ফুটবলার হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। পড়াশোনা শেষে ১৯৬৮ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন নিয়েছিলেন খেলাধুলা অব্যাহত রাখবেন বলেই। ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ পাকিস্তানের মুলতান থেকে ঢাকায় আসেন। পরে নিজ কর্মস্থল যশোর ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন মেজর হাফিজ।
দেশমাতৃকা রক্ষায় বাংলার অকুতোভয় সেনা দল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ৭১ এ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে তখনই পূর্ব বাংলার সেনানিবাসগুলোতে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালি সেনারা। এতে নেতৃত্ব দেয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। পরে তাদের নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে মুক্তিবাহিনী। এতে যোগ দেয় মুক্তিকামী সাধারণ জনতা।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাবেক মেজর হাাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত একমাত্র রেজিমেন্ট ছিল ইস্ট বেঙ্গল। যার পাঁচটি ব্যাটালিয়ন ছড়িয়ে ছিল পূর্ব বাংলার জয়দেবপুর, যশোর, কুমিল্লা, সৈয়দপুর আর চট্টগ্রামে। আর বাকি তিনটি ছিল পাকিস্তানের লাহোর ও করাচিতে।
একাত্তরের মার্চের ২০ তারিখের পর থেকেই বাঙালি সেনারা বুঝতে পারেন কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, যশোরের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমি একমাত্র বিরোধী অফিসার ছিলাম সেই সময়। যশোরের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে ৮ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ হয়। ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে থেকে বাইরে এসে দেখি হাজার হাজার যুবক দা, কুড়াল, খুন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন আমাদের বলেন ‘অস্ত্র দেন স্যার, যুদ্ধ করব’। এই বাঙালির যে স্পিরিট, স্বাধীনতার জন্য তাদের যে আকুতি, তাদের সাহসী মনোবল দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম আমি।
যেভাবে শুরু হয় বিদ্রোহ
৩০ মার্চ সকালে ব্রিগেডিয়ার সর্দার আব্দুর রহিম দুররানী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেকে নিরস্ত্র করার আদেশ জারি করেন। এই আদেশ শুনেই সৈনিকরা বিদ্রোহ করে। অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে নেন সৈনিকরা। পরে মেজর হাফিজকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানালে বিদ্রোহের পক্ষে অবস্থান নেন তিনি। তিনি তাদের কমান্ডার হন। বাঙালিদের হয়ে এই লড়াইয়ে যোগ দেন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন। পরে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আট ঘণ্টার কঠিন সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে শহিদ হন আনোয়ার হোসেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মেজর হাফিজ।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে সৈনিকদের নিয়ে খিতিবদিয়ায় ঢুকি। সেখানে হাজার হাজার গ্রামবাসী দা, কুড়ালসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তত ছিল। আমাদের দেখে গ্রামবাসী বুকে টেনে নেন। জনগণের কাছেই শোনেন চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান নামে একজন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এভাবেই শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।
মেজর হাফিজ বলেন, এপ্রিলের পুরো মাস বেনাপোলে দুশো' সৈনিক নিয়ে রক্ষণভাগ গড়ে তুলি। পরে ইপিআরের আরও দুশো সৈনিক নিয়ে শক্ত রক্ষণভাগ গড়ে তুলি। এ সময় পাকিস্তানিরা কামানের গোলা বর্ষণ করে। কয়েক ঘণ্টা প্রতিরোধ করে দেড় কিলোমিটার পেছনে এসে আবারও প্রতিরোধ গড়েন সৈনিকরা। এরই মধ্যে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলায় অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। পরে যার নাম হয় মুজিবনগর। অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে থাকতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন রণাঙ্গণের এই বীরযোদ্ধা। অনুষ্ঠানে দেওয়া কর্নেল ওসমানীর নির্দেশক্রমে যশোর ও কুষ্টিয়ার ছয়শ’ যুবককে রিক্রুট করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নে রূপান্তর করেন। যার বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্র। দুঃসাহসী এই যুবকদের মেঘালয়ের তেলঢালা নামক স্থানে আনা হয় প্রশিক্ষণের জন্য।
মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ যোগ করেন, প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড- ‘জেড ফোর্স’। এর কমান্ডার নিযুক্ত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। প্রায় দেড়মাস প্রশিক্ষণের পর বৃহত্তর ময়মনসিংহে একাধিক যুদ্ধে করেন জেড ফোর্সের সদস্যরা। ২৯ জুলাই সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ হয় কামালপুরে, শক্তিশালী বেলুচ রেজিমেন্টের বিপক্ষে। এই শত্রু ঘাঁটিতে ছিল বাংকার, সামনে মাইনফিল্ড। এখানে আক্রমণ করার মতো লজিস্টিক সাপোর্ট ছিল না। তবু ৩১ জুলাই আমার এবং ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে দুশো সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করি। এতে ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিনসহ আমাদের অর্ধেক সৈন্য নিহত হন। আমি আহত হই। এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র ভয়াবহ কনভেনশনাল আক্রমণ।
সিলেট দখলের পরিকল্পনা
মেজর হাফিজ বলেন, ময়মনসিংহ থেকে সেপ্টেম্বরে জেড ফোর্সেকে নেওয়া হয় সিলেট অঞ্চলে। ২১ নভেম্বর ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সিলেট সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এতে মারাত্মকভাবে পরাস্ত হয় শত্রুপক্ষ। ২৩ নভেম্বর জকিগঞ্জের চারগ্রামে আমি আক্রমণ চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি প্যারামিলিটারি ফোর্সকে পরাস্ত করে চার গ্রাম দখল করি। এখান থেকে তারা পিছু হটতে থাকে। ২৮ নভেম্বর গৌরিপুরে পাকিস্তানের ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে তাদের ৫০ জন নিহত হয়। ২৬ জনকে জীবিত আটক করি। এই যুদ্ধে জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান যোগ দেন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত সিলেটের দিকে পিছু হটতে থাকে। আমরাও এগুতে থাকি।
হাফিজ বলেন, আমিসহ মেজর জিয়াউর রহমান ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ সিদ্ধান্ত নিলাম সবার আগে সিলেট দখলের কৃতিত্ব অর্জন করব। পরিকল্পনা অনুযায়ী, অপ্রচলিত পথ চা বাগানের মধ্য দিয়ে সিলেটের দিকে এগুতে থাকি। কামানের সহায়তা প্রদানের জন্য যোগ দেন ভারতীয় বাহিনীর একজন অফিসার। প্রায় ১২ শ’ সৈনিকের বাহিনী গেরিলা পদ্ধতিতে অগ্রসর হতে থাকি। তিনদিন পর সঙ্গে থাকা শুকনা খাবার ফুরিয়ে যায়। চতুর্থ দিন সিলেটের মালিনীছড়া চা বাগানের পেছনে একটি সাদা বিল্ডিং দেখতে পাই। এটাই ছিল এমসি কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন। বাসভবনের উল্টোদিকে টিলায় উঠে দেখি পাকিস্তানি সৈনিকরা বাংকারের ভেতর থেকে বের হয়ে রোদ পোহাচ্ছে। যুদ্ধ তখন চলছিল সিলেট থেকে আট মাইল দূরে। তারা কল্পনাও করেনি বাঙালিরা সিলেটে প্রবেশে করেছে। চিৎকার করে আমাদের পরিচয় জানতে চায়। আমরা কর্ণপাত না করে পরিখা খনন করতে থাকি। পরে তারা বুঝতে পারে।
মেজর হাফিজ বীর বিক্রম বলেন, ওই দিন ছিল ১৪ নভেম্বর। ঘণ্টাখানেক পর সংগঠিত হয়ে পাকবাহিনী আক্রমণ চালায়। দিনব্যাপী যুদ্ধে তাদের প্রায় ৪০ জন নিহত হন। আমার কোম্পানির সুবেদার ফয়েজ আহম বীর উত্তমসহ ১৪ জন শহীদ হন। এদিন বিকেলে মেজর রাও জানান, কামানের গোলা ফেলা যায় কি না। আমি বললাম, কামানের গোলা ফেললে পাকবাহিনীও একই কাজ করবে। অনুরোধ জানালাম, বিমান হামলা চালানোর। আধঘণ্টা পর ভারতীয় জেট বিমান এসে বাংকারগুলো ধ্বংস করে দেয়। এতে তারা মনোবল হারিয়ে আত্মসমর্পণের অভিপ্রায় জানায়। ১৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের কথা জানায়। এই বীরযোদ্ধা জানান, ৩০ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্টে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেই যুদ্ধ শেষ হল ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের মাধ্যমে।
সাহসী সেনা জিয়াউর রহমান
মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেজর হাফিজ বলেন, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমিতে আমাদের প্রশিক্ষক ছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয়। ১৯৭৩ এবং ৭৪ সালে মধ্যে দেড় বছর আমি সেনা দফতরে তার একান্ত সচিব ছিলাম। যখন জিয়াউর রহমান ছিলেন- ‘ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টার্ফ’।
হাফিজ বলেন, মেজর জিয়া ছিলেন একজন অদম্য সাহসী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি দক্ষতার সঙ্গে ‘জেট ফোর্স’ পরিচালনা করেছিলেন বলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে সাহসিকতার পুরস্কার পায় ‘জেড ফোর্স’।
হাফিজের ভাষ্য- যুদ্ধকালীন সময়ে জিয়াউর রহমান সিনিয়র অফিসার হিসেবে ইচ্ছা করলেই ভারত সীমান্তের ওপারে অপক্ষো করতে পারতেন। নিরাপদে নিরুদ্দেশ জীবন যাপন করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। সেনা সদস্যদের সঙ্গে তিনিও সামনের কাতারে এসে সবাইকে একতাবদ্ধ করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বলিষ্ঠ কন্ঠে স্বাধীণতার ঘোষণা দিয়েছেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেও তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কখনোই দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারেনি। দেশ প্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে দেশের জনগণ জিয়াউর রহমানকে আজীবন মনে রাখবে।
স্বাধীনতা নয়, আওয়ামী লীগ চেয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তান
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির কথা শুনি তখন খুব বেদনার্ত হই। আওয়ামী লীগ তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা চেয়েছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতা। অন্যদিকে নির্যাতিত মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন একজন সৈনিক মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং যুদ্ধ করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি নিজেও রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। দুইবার স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। দেশবাসী যখন একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শুনতে চেয়েছিলেন সেটিই প্রমাণ করেছিলেন মেজর জিয়া।
মেজর হাফিজ বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছিলেন; এ কারণেই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার কথা তিনি চিন্তাও করেননি। ব্যালটের রাজনীতি ছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যে স্বাধীনতার ঘোষণার কোনো মানসিকতাও ছিল না জানিয়ে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগ হরতাল ডেকেছিল। তাজউদ্দীন আহমদ টেপ রেকর্ডার নিয়ে তার বাসায় গিয়ে বারবার স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অনুরোধ করেছিলেন; কিন্তু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেনি। তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দিলে বিচ্ছিন্নতাবাদী হবে, ঘোষণা দিলে তিনি নাকি পাকিস্তানের সরকারের বিচারের মুখোমুখি হবেন, এমন কথা বলেছিলেন শেখ মুজিব। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি। অর্থাৎ স্বাধীনতা আওয়ামী লীগের মানসপটেই ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শক্তি খালেদা জিয়া
মুক্তিযুদ্ধে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবদান তুলে ধরে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়া ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা নারী। তিনি রাজনীতিতে আসার আগে থেকেই তাকে আমি চিনতাম। সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে তার বাসয় গিয়েছি। তার সরল সাধারণ জীবন খুব কাছ থেকে দেখেছি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে খালেদা জিয়া তার স্বামী জিয়াউর রহমানকে উৎসাহিত করেছিলেন। এমন কি তিনি নিজেও মুক্তিযুদ্ধেও সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। ফলে পাকবাহিনী ঢাকায় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। এক সময় হানাদার বাহিনী তাকে বন্দী করে। সে সময় তার সঙ্গে দুটি ছোট্ট শিশু সন্তান ছিল। তবু তার মনোবল অটুট ছিল। এতটুকুও ভয় পাননি।
এমনকি পাকিস্তানের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের অস্ত্র জমা দিতে বারণ করেন। তিনি সৈনিকদের যুদ্ধে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। সুতারাং বেগম জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অন্যতম শক্তি। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিএনপি নামক দলটিকে তিনি শক্ত হাতে পরিচালনা করেছেন। অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদ খালেদা জিয়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিটি নির্বাচনে তিনি জিতে এসেছেন। সুতারাং রাজনৈতিক অঙ্গনে বেগম জিয়া এক পাহাড়সম ব্যক্তিত্ব।
বিকৃতি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
খেতাবধারী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। যারা যখন ক্ষমতায় এসেছেন, তারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন। ফলে রণাঙ্গণের যোদ্ধাদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমানের খেতাব কেড়ে নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে বারবার।
তিনি যোগ করেন, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন করেছিলেন। অথচ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবু আমি হতাশ নই। নতুন দিনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে বলতে চাই, আগামী প্রজন্ম সংগ্রামের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধারা বঞ্চিত
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ দাবি করেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে, তারা সকল কৃতিত্ব ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাঙালি শ্রমিক, সৈনিক, ছাত্র-জনতার মিলিত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ সাধারণ সত্যটি স্বীকার করেনি আওয়ামী লীগ সরকার। এমন কি তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ কীভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছে। একাত্তরে রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা বলেন, সশস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা নীরব। এই যে সাধারণ মানুষের যুদ্ধকে রাজনৈতিক দলের যুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার জোর প্রবণতা আমাদেরকে আহত করে। তিনি বলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ শুরু না করলে দেশ আজও পাকিস্তান থাকত। দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে, এটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বরখেলাপ।
মেজর হাফিজ বলেন, একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রতিদিন গল্প-কবিতার মতো লেখা হচ্ছে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৮০ হাজার বা ১ লাখ, কিন্ত এখন দেখা যাচ্ছে, প্রায় আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে অংশগ্রহণ করা সেনা সদস্যদেও যোগত্যা অনুয়ায়ী খেতাব না দেওয়ার অভিযোগ তুলে হাফিজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অধিকাংশ খেতাব দেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের যারা যুদ্ধে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা; ৯ মাস ভারতেই অবস্থান করেছেন।
মেজর হাফিজের আক্ষেপ
মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমার বাবা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজেও পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সীমান্ত অতিক্রম করেননি। ভোলার বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে বেড়ান। তার পক্ষে আমার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমিও পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে পারিনি। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও আমি আওয়ামী সরকারের অনেক রোষানলের শিকার হয়েছি। অসংখ্য মিথ্যা মামলার খড়গ মাথায় নিয়ে আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। ন্যায়বিচার পাইনি। গত ১৫ বছরে ৫ বার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছি। গেল বছর জেল খেটে বাইরে বের হয়ে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। অথচ আমাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। এয়ারপোর্ট থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন ‘টেম্পরারিলি রিলিফ’ আছি। অন্তত আর গ্রেপ্তারের ভয় নেই। বাকিটা ভবিষৎ বলে দেবে- আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের ভবিষৎ কোন দিকে যাবে। দেশের জনতা বুকের রক্ত দিয়ে একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আশা করি আগামীতে অন্তত দেশে যেটাই হবে তা যেন মানুষের জন্য কল্যাণের জন্য কিছু হয়।
সবাই মিলে কল্যাণময় রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়
বিজয়ের মাসে এসে দেশের সাহসী জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ বলেন, বিজয়ের মাসে ছাত্র-জনতাকে আমার অন্তরের অন্তরস্থল থেকে ভালোবাসা জানাই। তারা তুমুল সংগ্রাম করে স্বৈরাচার হটিয়েছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধে ছাত্ররা সাহসী বিপ্লবী সেনা।
তিনি বলেন, স্বৈরাচার হটাতে ছাত্রদের পাশাপাশি আমার দল বিএনপির অবদানও কম নয়। এই দলটি গত ১৭ বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লাড়াই-সংগ্রাম করেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র জনতার মিলিত শক্তির কাছে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয় হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সম্ভবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অনেকেই একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। জুলাই বিপ্লবও ছিল একই রকম।
মেজর হাফিজ প্রত্যাশা রাখেন বহু বছর পরে দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নতুন করে সুযোগ পেয়েছি। আশা করি সবাই মিলে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণময় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলব। এই আগস্ট বিপ্লব যেন ব্যর্থ না হয় এ জন্য আমরা বর্তমান সরকারকেও সাহায্য সহযোগিতা করব। তাইতো নতুন করে দেশ গড়তে আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছি।