শিরোনাম
\ গোলাম আহাদ \
ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৪ (বাসস) : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলা মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বদানকারী জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী কেন পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজিত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না তা রহস্যজনক।
নিয়াজী আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার কাছে তার অস্ত্র হস্তান্তর করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার আগে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।
তবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ওসমানীর অনুপস্থিতি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করে এবং এটি নিয়ে এখনও একটি রহস্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উপেক্ষা করে ভারতীয় কমান্ডারদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে কি না?
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর উপ-প্রধান এ কে খন্দকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তবে তার উপস্থিতি খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তাকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।
মূলত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিভিন্ন পক্ষের কাছে বিভিন্ন অর্থ বহন করে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে এটি ছিল মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার এক বিজয়ের ইতিহাস। কিন্তু ভারতের জন্য এটি ছিল উপমহাদেশের আরেকটি অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ।
ওসমানীর অনুপস্থিতির কোনো স্পষ্ট কারণ পাওয়া যায়নি। তার উইকিপিডিয়া পেজে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সময় ওসমানী ঢাকায় ছিলেন না। সিলেট থেকে তার হেলিকপ্টারটি মাঝপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়।’ তবে, সিলেট অঞ্চলে কারা ওসমানীর হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, তা স্পষ্ট নয়, কারণ দুই দিন আগেই এই অঞ্চল মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল।
ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণের দলিলে পাকিস্তানি এবং ভারতীয় কমান্ডাররা স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কোনো প্রতিনিধির স্বাক্ষর ছিল না। যদি ওসমানী সেখানে উপস্থিত থাকতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিত্ব করতেন, তবে এটি বাংলাদেশের একটি স্বাধীন পক্ষ হিসেবে উপস্থিতিকে তুলে ধরতে পারত এবং এটি একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিজয়ের প্রতীক হতে পারত।
আত্মসমর্পণের দলিলের তিনটি অনুচ্ছেদের একটি নিবিড় বিশ্লেষণ এই ধারণা দেয় যে পাকিস্তানি বাহিনী যেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, এতে মনে হয় যেন তারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের দখল নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো তখন পুরো দেশই বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে গিয়েছিল।
আত্মসমর্পণের দলিলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘এই দলিলে স্বাক্ষরের পর থেকে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার আদেশ অনুযায়ী কাজ করবে। আদেশ অমান্য করা আত্মসমর্পণের শর্ত লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে এবং তা যুদ্ধের আইন ও রীতিনীতির আওতায় বিচার করা হবে। আত্মসমর্পণের শর্ত সম্পর্কে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।’
দলিলের তৃতীয় ও শেষ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয় যে স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের নিরাপত্তা এবং সম্মানের নিশ্চয়তা দেয়।
দলিলের শেষাংশে উল্লেখ করা হয়, ‘লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বিধিসম্মতভাবে আশ্বাস দেন যে আত্মসমর্পণ করা সদস্যদেরকে সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যদের সুরক্ষা ভারতীয় বাহিনীর অধীনে নিশ্চিত করা হবে।’
আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে ওসমানীর উপস্থিতি এবং দলিলে তার স্বাক্ষর এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারত। তাছাড়া, তার অনুপস্থিতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।