শিরোনাম
ঢাকা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন ঢাকা ও চট্টগ্রামে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ আমলের বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার দ্বারা পরিচালিত আটটি গোপন আটক কেন্দ্রের সন্ধান পেয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আজ পর্যন্ত আমরা (কমিশন) আটটিরও বেশি গোপন আটক কেন্দ্র সনাক্ত করেছি। এসব আটক কেন্দ্র ডিজিএফআই (ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স), র্যাব (র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন), এবং সিটিটিসি’র (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মতো এজেন্সিগুলো দ্বারা পরিচালিত হতো। সারা দেশ থেকে আটককৃতদের এখানে রাখা হয়েছে।’
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিশন শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব গোপন আটক কেন্দ্রগুলির মধ্যে কয়েকটি এখনও অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে, অন্যগুলি ধ্বংস করা হয়েছে। এতে বলা হয়, তারা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ, আটক কেন্দ্র এবং সরঞ্জাম পরিদর্শন করাসহ তথ্য ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর ১২টি অফিস পরিদর্শন করেন এবং আইন প্রয়োগকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তদন্তের নিরাপত্তার স্বার্থে এর বিস্তারিত বিবরণ ভবিষ্যতে প্রকাশ করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আপাতত আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে আমরা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স; কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম; গোয়েন্দা শাখা সদর দপ্তর, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ; গোয়েন্দা শাখা, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ; র্যাব ২, সিপিসি ৩সহ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ইউনিট ১, ২, ৪, ৭ এবং ১১; র্যাব ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার; চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স, চট্টগ্রাম বিভাগ পরিদর্শন করেছি।
এতে বলা হয়েছে, সামরিক অফিসারদের ব্যবস্থাপনায় এবং পুলিশের মতো বেসামরিক বাহিনী দ্বারা এসব আটক কেন্দ্রের নৃশংস নির্যাতনের উল্লেখযোগ্য বিবরণ নথিভুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিবি এবং সিটিটিসি’র মতো বেসামরিক বাহিনী দ্বারা পরিচালিত এসব কেন্দ্রগুলিতে এমনভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছিল, যা এই অফিসগুলির দৈনন্দিন কার্যক্রমের সঙ্গে একীভূত হয়েছিল।
রিপোর্টে বলা হয়, নির্যাতনের কাজগুলি নিয়মিতভাবে নিরাপত্তা কর্মীদের দ্বারা একই জায়গার করা হতো যদিও নির্যাতনের জন্য বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে। ‘বন্দিরা রিপোর্ট করেছে যে, যন্ত্রণা-অত্যাচার-অত্যাচার করার এমন এলাকার কাছাকাছি থেকেই অফিসাররা তাদের ডেস্কে বা কম্পিউটারে শান্তভাবে কাজ করছে।’
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘বিপরীতভাবে, র্যাব ও ডিজিএফআই’র মতো সামরিক কমান্ডারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত নির্যাতন কেন্দ্রগুলো অনেকাংশে শব্দরোধী চেম্বার এবং বিশেষ যন্ত্র দিয়ে সজ্জিত ছিল, যা স্পষ্টভাবে শারীরিক এবং মানসিক আঘাতের জন্য বানানো হয়েছিল।’
কমিশন বলেছে যে তারা চলমান তদন্তের নিরাপত্তার স্বার্থে বিস্তারিত বিবরন আপাতত এখানে দিচ্ছেন না, তবে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তা প্রকাশ করা হবে। কমিশন জানায়, ‘এই পর্যায়ে, আমরা নির্যাতনের প্রকৃতি এবং তীব্রতা বোঝাতে দুটি উদাহরণ উপস্থাপন করছি।’
২০১০ সালে ধানমন্ডি থেকে এক যুবককে অপহরণ করে র্যাব। তিনি রিপোর্ট করেছেন যে, তাকে একটি ঘরে নিয়ে কোনো চেতনানাশক ছাড়াই তার ঠোঁট সেলাই করা হয়েছিল। তিনি এই পদ্ধতিটিকে গরুর চামড়া সেলাই করার মতো বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি এতে তারে প্রতি যে অমানবিকতা প্রকাশ করা হয়েছিল, তার উপর জোর দিয়েছেন।
কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পৃথক আরেকটি ঘটনায় একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন যে, র্যাবের দ্বারা তার যৌনাঙ্গ এবং কানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা হয়েছিল। ঘটনার আট বছর পর তিনি এ বর্ণনা করেন।
সাময়িক এবং ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি শুধুমাত্র পদ্ধতিগত নয়, এই সমস্ত শক্তির মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিকতাও ছিল বলে কমিশন মত দিয়েছে।
কমিশন বলেছে যে তারা ইতোমধ্যেই মোট ১ হাজার ৬৭৬ টি বলপূর্বক গুমের অভিযোগ রেকর্ড করেছে, এবং ৭৫৮ টি অভিযোগ ইতিমধ্যেই যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। দেশে জোরপূর্বক গুমের সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
রিপোর্টে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ভেঙে দেওয়ারও সুপারিশ করা হয়।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, তারা একটি ‘সিস্টেমেটিক ডিজাইন’ খুঁজে পেয়েছেন যাতে বলপূর্বক গুমের ঘটনা অনাবিষ্কৃত থাকে। তিনি বলেন, তারা মার্চ মাসে আরেকটি অন্তর্র্বর্তী প্রতিবেদন প্রদান করবেন এবং প্রাপ্ত সমস্ত অভিযোগের যাচাই-বাছাই শেষ করতে তাদের কমপক্ষে আরও এক বছর লাগবে।