শিরোনাম
রংপুর, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, কবিতা, প্রবন্ধ এবং নিবন্ধ ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে স্থাপন করা হয়েছে ‘চির উন্নত মম শীর’ স্বাধীনতা স্কয়ার।
আগামীকাল বুধবার এর উদ্বোধন করবেন কবি নজরুল ইনস্টিটিউট এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক দেশের বরেণ্য কবি, বহুমাত্রিক লেখক ও নজরুল বিশেষজ্ঞ আব্দুল হাই শিকদার।
সরেজমিনে জানা যায়, রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের একাডেমিক বিল্ডিং এর উত্তর-পশ্চিম কর্নারে শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন করা হয়েছে নান্দনিক ডিজাইনের এই স্বাধীনতা স্কয়ার। মার্বেল পাথর এবং টাইলসে সুশোভিত করা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মুরাল।
সন্নিবেশন করা হয়েছে টুপি পরিহিত কবি কাজী নজরুলের সেই বিখ্যাত ছবি। ছবিটি এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যেন ছবির মধ্যে বিদ্রোহের আগুন রয়েছে, সাম্যের গান আছে, শোষণের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার আছে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবিতা আছে, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রেরণা আছে এবং মানুষে মানুষে ভালোবাসার গান আছে।
পাশে লেখা হয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বৈষম্যহীন মানবিক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক ’কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটির চার লাইন যেখানে লেখা রয়েছে-
‘অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তিপণ!
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র!"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা রংপুরের পুলিশ সুপার মো. শরীফ উদ্দিনের পরিকল্পনায় নান্দনিক ডিজাইনের এই মুরালটি স্থাপন করেছেন।
পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ(একাডেমিক) জাহাঙ্গীর আলম জানান, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতির একজন প্রকৃত জাতীয়তাবাদী কবি। ব্রিটিশ শাসনামলে নজরুল ইসলাম তার কবিতায় ভারতবাসীর সার্বিক মুক্তির জন্য বিদ্রোহের ঝান্ডা তুলেছিলেন। নজরুলের এই বিদ্রোহ ছিল মূলত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে কবি নজরুল একজন জাতীয়তাবাদী কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও পরবর্তীতে তিনি সরকারিভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী কবি হতে পারেননি। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ কবি নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের একজন দেশ প্রেমিক মানবতাবাদী ও জাতীয়তাবাদী কবি হিসেবে নন্দিত হয়েছেন। বর্তমান বিপ্লবী সরকার নজরুল ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান ভীষন ভাবে প্রেরণা যুগিয়ে ছিল। তাই পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজ রংপুর নজরুলকে নতুন করে এ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবার জন্যই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা ।
তিনি বলেন, ‘দেশ বরেণ্য কবি আবদুল হাই শিকদারের উপস্থিতিতেই নজরুলের চেতনা রংপুর তথা বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়বে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
পুলিশ লাইন্স স্কুল এন্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ (প্রশাসন) আ. ন. ম বাবর আলী জানান, ‘যেহেতু কবি কাজী নজরুল ইসলাম জুলাই বিপ্লব বাস্তবায়নের প্রেরণার উৎস। সে কারণে বিপ্লবের পর পরই আমরা কবি কাজী নজরুল নজরুল ইসলাম চর্চাকে অমৃত করবার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছি।’
রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক জালাল উদ্দিন আকবর জানান, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রথম বিজয় দিবস রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজের পক্ষ থেকে মাস ব্যাপী উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরই আলোকে আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে স্বাধীনতা স্কয়ার নির্মাণ করেছি। আমরা মনে করি এর মাধ্যমে নজরুল চর্চা শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগাবে এবং প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যদি এভাবে নজরুল চর্চার উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। তাহলে নজরুল আমাদের মাঝে আরো অনিবার্য হয়ে উঠবে।
রংপুরের পুলিশ সুপার মো. শরীফ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই উপমহাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের মনোজগতে বিরাজমান। তার গান ও কবিতা এবং প্রবন্ধ ও নিবন্ধ জাতীয়তাবাদের আদর্শের প্রতিক। বৈষম্য এবং ভেদাভেদের বিরুদ্ধে ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্য তার লেখালেখি পৃথিবী যতদিন বিরাজমান থাকবে ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে। জুলাই বিপ্লবে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে উঠেছিলেন সব থেকে বড় প্রাসঙ্গিক। দেখা গেছে জুলাই বিপ্লবে ছাত্র জনতার সমস্ত উচ্চারণে কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান কবিতা এবং প্রবন্ধ ও নিবন্ধন। আমরা মনে করেছি তরুণ প্রজন্মের কাছে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে চর্চার জন্য এর প্রতিটি প্রান্তে উদ্যোগ থাকা প্রয়োজন। এ কারণে ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মরণে স্বাধীনতা স্কয়ার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা মনে করি এখানে নজরুল চর্চার নতুন দার উন্মোচন হবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকরা নজরুলের অনিবার্যতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমরা চেষ্টা করেছি নান্দনিক ভাবে এই স্কয়ার নির্মাণ করতে। এজন্য আমরা কান্ডারী হুশিয়ার কবিতাটির চারটি লাইন সংযোজন করেছি মুরালের পাশে। যে চারটি কবিতার মধ্যে মানবিকতা অসাম্প্রদায়িকতা এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি রয়েছে। আমরা শিক্ষার্থী অভিভাবক এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরকেও নজরুল চর্চায় আগ্রহী করতে চাই। সে কারণেই আমাদের এই উদ্যোগ। এজন্য আমরা প্রখ্যাত নজরুল গবেষক নজরুল ইনস্টিটিউটের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কবি আব্দুল হাই শিকদারকে দিয়ে এই স্কয়ার উদ্বোধন করছি।
নজরুল ইনস্টিটিউট এর সাবেক নির্বাহী পরিচালক বহুমাত্রিক কবি আব্দুল হাই সিকদার সাংবাদিকদের জানান, একজন মানুষের জন্য যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, আলো এবং বাতাস প্রয়োজন- ঠিক তেমনিভাবে বাংলাদেশের জন্য সবসময়ই প্রাসঙ্গিক কবি নজরুল। বাংলাদেশ মানেই নজরুল। যেখানে শোষণের বিরুদ্ধে শোষিতের উচ্চারণ সেখানেই নজরুল।
কবি আব্দুল হাই শিকদার আরো বলেন, জুলাই বিপ্লবের প্রতিটি উচ্চারণে তাই কবি নজরুলের লেখা অনিবার্য বিপ্লবের প্রতীক হয়ে স্লোগান দেয়াল লিখনসহ প্রতিটি কর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ নজরুলকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে নজরুল স্কয়ার নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে এজন্য রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল এন্ড কলেজকে ধন্যবাদ জানাই।
এর মাধ্যমে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিকতা নতুন প্রজন্মের কাছে আলোড়িত এবং জাগড়িত হবে। এর মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত হবে।
বহুমাত্রিক এই বরেণ্য কবি আরো বলেন, নজরুল স্কয়ার উদ্বোধনের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করায় আমি নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি।
প্রসঙ্গত: ১৯৮৭ সাল থেকেই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে মর্যাদা দেয়া হলেও এ বিষয়ে কোনো গেজেট প্রকাশিত হয়নি। শুধুমাত্র কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট আইনেই তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা আছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনে কবিতা, গান, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান তুলনাহীন।