শিরোনাম
মুন্সীগঞ্জ, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ ( বাসস ) : গঙ্গানদীর উপর নির্মিত ফারাক্কা ব্যারেজের প্রভাবে নদী বেষ্টিত মুন্সীগঞ্জ জেলা তার পরিচিতি হারাতে বসেছে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং এবং টঙ্গিবাড়ী অংশে পদ্মায় পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় তীব্র খরস্রোতা ধলেশ্বরী এবং ইছামতি নদীসহ অনেক শাখা নদী শুকিয়ে খালে পরিণত হয়ে অস্তিত্ব হারাতে যাচ্ছে। নদীর বুকে চর পড়ে হয়ে যাচ্ছে বেদখল। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বিরুপ প্রভাব পড়বে নৌ - যোগাযোগ , কৃষি এবং মৎস্য চাষে।
এক সময় বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী আর ইছামতি নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল। কালের পরিক্রমায় খরস্রোতা ধলেশ্বরী এবং ইছামতি নদী তার চিরচেনা রুপ হারিয়ে ফেলেছে। পদ্মা, মেঘনা, ইছামতি আর ধলেশ্বরী নদীতে হুইসেল বাজিয়ে জাহাজের যাত্রা, নোংগর ফেলা এবং পাল তোলা বড় বড় নৌকায় মাল পরিবহনের চিত্র হারিয়ে গেছে। এসব এখন শুধুই ইতিহাস।
পদ্মার ভাংগনে এবং নাব্যতা কমে যাওয়ায় বিরুপ প্রভাব পড়ে ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীতে। পদ্মার বালু বর্ষায় এবং গৌড়গঞ্জ খাল দিয়ে এসে পড়ে ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীতে। গত এক যুগে ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় অনবরত নদীর বুকে চর পড়তে থাকে । ফলে তীব্র খরস্রোতা ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদী যৌবন হারিয়ে খালে পরিণত হয়ে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ভরাট হয়ে গেছে অনেক শাখা নদী । নাব্য সংকটের কারনে বন্ধ হয়ে গেছে লৌহজং-ঢাকা, তালতলা-মুন্সীগঞ্জ-নারায়নগঞ্জ নৌ-পথ। আর ফসলী জমিতে সেচ কার্যক্রম, মালামাল পরিবহনও ব্যাহত হচ্ছে । ঐতিহ্য হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী মীরকাদিম ও লৌহজং বন্দর। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় তীরবর্তী ফসলী জমিতে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না এতে বিরুপ প্রভাব পড়েছে ফসল উৎপাদনে। মৎস্য জীবীদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেছে।
ধলেশ্বরী ইছামতি নদী দিয়ে সারা বছর লৌহজং-ঢাকা এবং তালতলা-মুন্সীগঞ্জ-নারায়নগঞ্জ রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ এবং মালবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করত। মালামাল পরিবহনে সুবিধা থাকায় নদী তীরবর্তীতে গড়ে উঠে মীরকাদিম বন্দর। বিআইডব্লিউটিএ লৌহজংয়ে ডহুরী, বালিগাঁও লঞ্চঘাট স্থাপন করে। তালতলা-মুন্সীগঞ্জ ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ নৌ-পথে তালতলা, বেতকা, আবদুল্লাপুর এবং মুন্সীগঞ্জে লঞ্চঘাট ছিল। সিরাজদিখান টংগীবাড়ী লৌহজং উপজেলার মানুষ প্রধানত নৌ-পথে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও নারায়নগঞ্জে যাতায়াত করত। গত দেড় যুগ পুর্বেও গৌড়গঞ্জ খাল দিয়ে লৌহজং কাঠপট্টি হয়ে ঢাকায় যাত্রীবাহী বড় বড় লঞ্চ ও মালবাহী কার্গো চলাচল করত। নদীপথের সুবিধা থাকায় ধলেশ্বরী নদীর তীরে গড়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী পাটকল বেতকা ব্রড বারলাবসহ আটটি হিমাগার । দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ধান সরিষা আসতো কাঠপট্টির ধানকলে এবং সরিষার ঘানিতে।
ধলেশ্বরী এবং ইছামতি নদী নাব্যতা হারানোর কারনে লৌহজং-কাঠপট্টি-ঢাকা, সিরাজদিখান-মুন্সীগঞ্জ- নারায়নগঞ্জ এবং তালতলা-মুন্সীগঞ্জ-ঢাকা যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে । বিআইডব্লিউটিএ গত কয়েকবছর পূর্বে তালতলা, বেতকা, আবদুল্লাপুর লঞ্চঘাটের পল্টুন ও সরিয়ে নিয়েছে । নৌ-পথকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা মীরকাদিম বন্দর , তালতলা , বেতকা এবং আবদল্লাপুর বাজার এখন মৃত প্রায়। নাব্যতা সংকটে মীরকাদিম বন্দরের কাঠপট্টি ঘাটও বন্ধের উপক্রম। দিনে দিনে নদীর প্রশস্থতা কমছে এবং নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। দখল প্রক্রিয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে তালতলা-ইছাপুরা-শ্রীনগর খাল এবং বালিগাঁও-লৌহজং খাল।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং এসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আলমগীর কবীর বলেন, ধলেশ্বরী এবং ইছামতি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলে সিমেন্ট পরিবহনে খরচ বৃদ্বি পেয়েছে। ধলেশ্বরী, ইছামতি এবং গৌড়গঞ্জ খালে নাব্যতা থাকলে মুক্তারপুর অঞ্চলে উৎপাদিত সিমেন্ট খুব সহজে কম খরচে নৌ পথে উত্তরাঞ্চলে পরিবহন করা যেতো। বর্তমানে এখানকার পণ্য উত্তরাঞ্চলে যেতে ১৬৪ কিলোমিটার ঘুরে চাঁদপুর হয়ে যেতে হয়।এতে ৩৭ কিলোমিটার যেতে প্রায় ১২৭ কিলোমিটার বেশী দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় এবং সময় এক দিন বেশী লাগায় পরিবহন খরচও অনেক বেশি হয়। কাঠপট্টি থেকে গৌড়গঞ্জ খাল হয়ে পদ্মানদী পর্যন্ত নাব্যতা ফিরে আনতে পারলে উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলে নৌ পথে পণ্য পরিবহন সহজ হয় এবং খরচ অনেক কমে যায়। মুন্সীগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মোঃ মুজিবুর রহমান বাসসকে বলেন-পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী এবং ইছামতি মুন্সীগঞ্জের গর্বের ইতিহাস। ব্যক্তিস্বার্থে নদী দখল আর মানব সৃষ্টে ভরাট হওয়ায় নদী ক্রমাগত তার নাব্যতা হারাচ্ছে। ফলে পণ্য পরিবহন, ফসল উৎপাদন এবং চাষাবাদ ব্যহত হচ্ছে, বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম নদী তীরবর্তী হিমাগার সমূহ। ইছামতি এবং ধলেশ্বরী নদী নাব্যতা হারানোর ফলে মুন্সীগঞ্জ তার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারাতে বসেছে। তিনি বলেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে নিয়মিত নদী ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
আবদুল্লাপুর বাজারের ডা. আব্দুল আলিম বাসসকে বলেন, ইছামতি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় আবদুল্লাপুর এবং বেতকা বাজারের আলুর আড়ৎ এবং হাট হুমকির মুখে। তালতলা থেকে কাঠপট্টি পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদী নিয়মিত ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা আবশ্যক। বেতকা গ্রামের চাষী জামাল বেপারী জানান, শুষ্ক মৌসুমে ধলেশ্বরী নদীতে পানি না থাকায় জমিতে সেচ দেওয়া যায় না। বিশেষ করে আলু মৌসুমে জমিতে নদী খাল থেকে পানি দিতে না পারায় উৎপাদন খরচ বৃদ্বি পায় এবং ফসল উৎপাদনও কম হয়।