শিরোনাম
রেজাউল করিম মানিক
রংপুর, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : নদীবেষ্টিত রংপুর অঞ্চলের অন্তত ৩ শতাধিক চরের মানুষের একমাত্র যোগাযোগের ভরসা চরের জাহাজ খ্যাত ঘোড়ার গাড়ি । চরের রাস্তাগুলো বালুকাময় হওয়ায় অন্য কোন যানবাহন এ এলাকাগুলোতে চলাচল করতে না পারায় বছরজুড়েই দুভোর্গে থাকে চরের মানুষ ।
আর তাই তিস্তা,ধরলা, নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলের কৃষিপণ্য পরিবহনের একমাত্র পরিবেশবান্ধব বাহন ঘোড়ার গাড়ি। চরের ধু ধু বালুতে অন্যান্য বাহন ব্যবহার না হওয়ায় কদর বেড়েছে ঘোড়ার গাড়ির। মাঠ থেকে সিংহভাগ সোনার ফসল গোলায় তুলতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ‘চরের জাহাজ’ খ্যাত ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হওয়ায় কৃষিপণ্য বাজারজাত করে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন কৃষকরা।
রংপুরের কাউনিয়ায় বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘চরের জাহাজ’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে ঘোড়ার গাড়ি। এ চরাঞ্চলে রয়েছে প্রায় ৪ শতাধিক ঘোড়া গাড়ি।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তিস্তাবেষ্টিত রংপুরের কাউনিয়ায় মাঠে মাঠে ধান কেটে ঘরে তোলার দৃশ্য চোখে পড়ে। ঘোড়ার গাড়িতে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে কৃষিপণ্য পরিবহন করা হচ্ছে কৃষকদের গোলায় ও বাজারে। একদিকে একমাত্র ভরসা ঘোড়ার গাড়ির কদর যেমন বেড়েছে তেমনি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে।
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তিস্তা নদীবেষ্টিত ১৭টি চরাঞ্চলের গ্রাম আরাজি হরিশ্বর, শনশনাটারি, গনাই, চর বিশ্বনাথ, চর নাজিরদহ, শুভাঘাট, চর সাব্দি, গোপিডাঙ্গা, চর গদাই, চর পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুকশাহাবাজ, চর গনাই, হরিচরন শর্মা, হয়বতখাঁ চর, টাপুর চর, সদরা তালুক, চর আজমখাঁ ঘুরে দেখা গেছে এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় একমাত্র বাহন হিসেবে স্থান করে নিয়েছে পরিবেশবান্ধব ঘোড়ার গাড়ি। এ বাহনের সুফলে কৃষিপণ্যে ন্যায্য দাম পেয়ে হাসি ফুটেছে কৃষকদের।
কাউনিয়া উপজেলার হরিশ্বর চরের কৃষকরা বলেন, আগোত হামার ঘামঝড়া ফসল খ্যাতোত থাকি বেচাইছি অল্প ট্যাকাত। দূরান্তের বাজারোত তুলবার পাই নাই গাড়ির জইনতে। এল্যা ঘোড়ার গাড়ি হয়্যা ফরিয়ার কাছোত না ব্যাচা খায়। বাজারোত নিয়া দাম ভাল পাওয়া যায়।
বিভিন্ন চরে ঘোড়া গাড়ির ব্যবহারের ফলে বেকারদের কর্মসংস্থানের নব দিগন্তের সূচনা হয়েছে। এ উপজেলার সিংহভাগ রবি শস্য, ধান, আলু, ভুট্টা, পাট, বাদাম,পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, ডাল, কুমড়া এ অর্থকরী ফসল চরাঞ্চলের মাটিতে বেশি উৎপাদন হয়। একটা সময় কৃষকের উৎপাদিত ফসল হাটে নিয়ে যেতে না পারায় কম দামে ফড়িয়া দালালদের কাছে বাধ্য হয়ে মাঠেই বিক্রি করতে হতো। কিন্তু বর্তমানে ঘোড়ার গাড়ি চালু হওয়ায় ভাগ্য বদলেছে কৃষকের। এখন তাদের উৎপাদিত ফসল হাটে নিয়ে ন্যায্য দামে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউপির গোপিঙ্গা গ্রামের ঘোড়ার গাড়িচালক আব্দুর রহমান জানান, আগোত খ্যায়া না খ্যায়া দিন কাটাছি কোন কাম আছিল না। এ্যালা ঘোরার গাড়ি চালেয়া কামাই রোজগার ভাল হয়। মোটামুটি ছইল পইল নিয়া সংসার চলে।
একই উপজেলার পল্লীমারী একতা গ্রামের ঘোড়ার গাড়িচালক গনি মিয়া, রহিম, নূর মিয়া জানান, এক কতায় কওয়া নাগে ঘোড়ার গাড়ি হামার ভাগ্যের চাকা ঘুরি দিছে। আগোত ভুই বাড়িত কাম থাকলে প্যাটোত ভাত গেইছে নাইলে নাই৷ এল্যা প্রায় ৫ বছর থাকি ঘোড়া গাড়ি চালায়া প্রতিদিন ৭০০-৮০০ টাকা পাই৷ এমনি দিনের থাকি ফসল তোলার সময় আয় ভাল হয়।
ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা জানতে চাইলে হারাগাছ ইউপি সাবেক চেয়ারম্যান রাকিবুল হাসান পলাশ জানান, তার ইউনিয়নে দেড় শতাধিক ঘোড়া গাড়ি আছে। টেপামধুপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়নে শতাধিক ঘোড়া গাড়ি আছে। শহীদবাগ ইউপি মেম্বার সোলেমান মিয়া জানান, তার ইউনিয়নে ৫০ থেকে ৬০টি ঘোড়া গাড়ি রয়েছে। বালাপাড়া ইউপি মেম্বার আনোয়ার হোসেন জানান, তার ইউনিয়নে ৮০ থেকে ৯০টি ঘোড়া গাড়ি আছে।
রংপুরের গংগাচড়ার চর ইচলি গ্রামের কৃষক জহুরুল হক বলেন, প্রতি বছর ৮ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ফসল ফলাই । এসব ফসল,কাটা মাড়াই থেকে বাজারজাত করা পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িই ব্যবহার করতে হয় । নিজেরই গাড়ি থাকায় অনেক সুবিধায় রয়েছেন বলেও তিনি জানান।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা জানান, প্রায় ৫-৭ বছর আগেও এ উপজেলায় ঘোড়ার গাড়ি তেমন চোখে পড়ত না। পরিবেশবান্ধব এ ঘোড়ার গাড়ি কৃষকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে পাশাপাশি বেকারদের কর্মসংস্থানের নব দিগন্তের সৃষ্টি হয়েছে।
রংপুর কৃষি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল বাসস কে বলেন, ঘোড়ার গাড়ি পরিবেশবান্ধাব হওয়ায় চরের জনপ্রিয় যানবাহন এখন এ গাড়ি । চরের মানুষ সখ করে এ গাড়ির নাম দিয়েছে চরের উড়োজাহাজ । আমরা কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের ঘোড়া কেনার জন্য আপদকালিন সহায়তার কথা ভাবছি ।