শিরোনাম
ইব্রাহিম খলিল মামুন
কক্সবাজার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : কক্সবাজার ভ্রমণ বলতে এখন শুধু কলাতলী, সুগন্ধা কিংবা লাবণী পয়েন্টে দাঁড়িয়ে সাগর দেখা বোঝায় না। শহরের নাজিরারটেক থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার অবিচ্ছিন্ন সমুদ সৈকতও এখন কক্সবাজার ভ্রমণের অন্তর্গত। এই পুরো এলাকায় দেখার আছে অনেক কিছু।
পর্যটন নগরী কক্সবাজারে সড়ক, রেল, আকাশ ও জলপথে এসেছে পরিবর্তন। গত বছরের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম ও ঢাকার সঙ্গে রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে। কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই বিমানবন্দরকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সমুদ্রে সম্প্রসারণ করা হয়েছে রানওয়ে।
অথচ এক দশক আগেও কক্সবাজার ছিল শুধু শীতের পর্যটন এলাকা। সে দিন বদলেছে। তবে এখনও সৈকতের কয়েকটি পয়েন্ট ছাড়া নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি থাকায় পর্যটকেরা নিরাপদে ঘুরতে পারেন না। সুতরাং গেলাম আর ঘুরে এলাম, এভাবে কক্সবাজার দেখার সময় শেষ। এখন কক্সবাজারকে আবিষ্কারের সময়।
তাই কক্সবাজারকে আবিষ্কার করতেই উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজারকে স্মার্ট নগরীতে রূপান্তর করতে ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ চলছে।
জানা যায়, সাশ্রয়ী গণপরিবহন রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে কক্সবাজার। এ পথ দিয়ে কক্সবাজারে আসছে পর্যটকরা। খুব শিগগিরই কক্সবাজার বিমানবন্দরের দ্বিতীয় রানওয়ে খুলে দিলে সমুদ্র্র ছুঁয়ে বিমান নামবে পর্যটননগরীতে। ইতিমধ্যে কক্সবাজারের সঙ্গে সড়ক, রেল ও বিমান পথে স্বাচ্ছন্দ্যের ত্রিমাত্রিক যোগাযোগ শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন আরও বিপুলসংখ্যক মানুষ পর্যটননগরী কক্সবাজার বেড়াতে আসবে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের বিনোদনে পরিকল্পিত কোনো উদ্যোগ এখনো গড়ে ওঠেনি।
কক্সবাজার ঘিরে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা:
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজারে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রণীত হয় একটি মাস্টারপ্ল্যান। কিন্তু সমন্বিত পরিকল্পনার অভাবে তা কার্যকর হয়নি। দীর্ঘদিন পর অবশেষে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তৎপরতায় শুরু হয়েছে নতুন মাস্টারপ্ল্যান (১ম সংশোধিত) তৈরির কাজ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কনস্ট্রকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট-সিএসসির তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৪ কোটি ৭২.৪৭ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএসসি নিয়োগ ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন করে। প্রকল্পের বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। এর মাধ্যমে ‘কক্সবাজারকে স্মার্ট শহরে রূপান্তরের’ জন্য ২০২৩ থেকে ২০৪৩ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ চূূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হবে মাস্টারপ্ল্যানটি, যা বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে কক্সবাজারের উন্নয়নচিত্র।
কক্সবাজার জেলার আট উপজেলা টেকনাফ, উখিয়া, রামু, সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া ও সি-বিচ এরিয়ার প্রায় ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে মাস্টারপ্ল্যানের আওতায়। এ এলাকাগুলোর রয়েছে পৃথক বৈশিষ্ট্য। একেকটি এলাকায় একেক ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করার পক্ষে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কুতুবদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত প্রায় ৬৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হচ্ছে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিক্ষেত্র।
তবে এই বিস্তৃত এলাকা পরিকল্পিত উন্নয়নের আওতায় আনতে বিপুল বিনিয়োগ এবং উদ্ভাবনী পরিকল্পনা দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট সেক্টর সম্পৃক্ত করা ছাড়া পর্যটন খাতে বড় সাফল্য নিয়ে আসা সম্ভব নয়। সরকার নীতিসহায়তা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা ছাড়া সবকিছু করে দেবে তা ভাবা ঠিক নয়।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটকরা কক্সবাজারে শুধু সি-বিচ দেখতে আসেন না। তারা এক বেলা সি-বিচ দেখে আরও বাড়তি বিনোদন ক্ষেত্র খুঁজে বেড়ান। এ ক্ষেত্রে তাদের যাওয়ার জায়গা খুবই কম। পর্যটকদের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বিনোদনের জন্য সি-বিচের বাইরেও নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। বেসরকারি খাত সম্পৃক্ত করে এমিউজমেন্ট পার্কসহ অনেক পর্যটন স্পট ডেভেলপ করা যায়। কক্সবাজারে বহুমাত্রিক পর্যটন সম্ভাবনা কাজে লাগানোর এখনই সময়। বাণিজ্যিক ট্রেন যখন এসে গেছে, ব্যাপকহারে পর্যটকও আসবে। অথচ এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে কক্সবাজারে তেমন কোনো প্রস্তুতিই নেই।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নূরুল আবছার বলেন, বিদেশিদের জন্য একটি বিশেষায়িত পর্যটন অঞ্চল এবং দেশের দীর্ঘতম ও একমাত্র সামুদ্রিক রানওয়েসহ একটি অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ে তোলার মাধ্যমে কক্সবাজারকে পর্যটন ও বিমান চলাচলের বৈশ্বিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চায় সরকার।
সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার থেকে সাবরাং ও কক্সবাজার থেকে মহেশখালী পর্যন্ত ক্যাবল কার স্থাপন, সমুদ্রসৈকতে ওয়াটার স্পোর্ট ও অন্যান্য বিনোদনসুবিধা চালু, ইনডোর বিনোদন পার্ক, কক্সবাজার মেরিনা বে রিসোর্ট, মহেশখালীতে ইকো-রিসোর্ট, জীবনরক্ষা ও সামুদ্রিক পর্যটন বৃদ্ধি, ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে রোডম্যাপ প্রণয়ন, সি-প্লেন, ক্রুজ শিপ এবং হেলিকপ্টার পরিষেবা প্রবর্তন ও সমন্বিত কোস্টাল জোন ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উপ-নগর পরিকল্পনাবিধ মোহাম্মদ তানভীর হাসান রেজাউল বলেন, কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনা প্রণয়নসংক্রান্ত জরিপ প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো কক্সবাজার ও সংলগ্ন এলাকায় একটি আধুনিক ও আকর্ষণীয় পর্যটননগরী গড়ে তোলার জন্য জমির যৌক্তিক ব্যবহার নিশ্চিত করা।
আগামী ৫০ বছর জমিতে যে কোনো প্রকৃতির অপরিকল্পিত উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ এবং অঞ্চলের সুপরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা। কক্সবাজার জেলার বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনাসহ (ডিএপি) মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন। এ ছাড়া প্রকল্পের আওতায় রয়েছে টেকসই পরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পাহাড়, বন, জলাশয় ও সামুদ্রিক এলাকা সংরক্ষণ, সমুদ্র সৈকত সংরক্ষণ, অবৈধ ও অপরিকল্পিত স্থাপনা অপসারণ, পানি, ভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। দূষণ, বর্জ্য ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা।
সব ধরনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন সুবিধা নিশ্চিতকরণ, আবাসন পরিকল্পনা, সৈকতের সৌন্দর্যায়ন এবং ভূমিক্ষয় রোধে কক্সবাজার জেলার মহাপরিকল্পনার (১ম সংশোধিত) প্রণয়নের কাজ করা হচ্ছে।
কক্সবাজারে কোথায় বেড়াবেন:
কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড় থেকে শুরু হয়েছে ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক। পাহাড় ও সাগর ভাগ করে যাওয়া এই সড়ক দিয়ে গেলে বন্য প্রাণী ও পাখপাখালির হাঁকডাক, সমুদ্রের সারি সারি মাছ ধরার ট্রলার, ঝাউবন ও সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণ পর্যটকদের বিমোহিত করে। চলতি পথে ঘুরে দেখা যায় দরিয়ানগর পর্যটনপল্লি, হিমছড়ির জাতীয় উদ্যান, ছড়া ও ঝঁরনা। এরপর পড়ে প্যাঁচার দ্বীপ, ইনানী ও পাটুয়ারটেক পাথুরে সৈকত। আরেকটু এগিয়ে গেলে দেখা যাবে বাহারছড়ার গগনচুম্বী শতবর্ষী গর্জন বাগান ও টেকনাফ সৈকত।
কক্সবাজারের পাশেই রয়েছে মহেশখালী দ্বীপ। দেশের বৃহৎ রামু রাবারবাগান, চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক, ঘুমধুম কুমির প্রজননকেন্দ্র, লবণের মাঠ, চিংড়ি ও দিগন্ত ছোঁয়া মাছের ঘের, দেশের বৃহত্তম রামুর বুদ্ধমূর্তি এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিভিন্ন স্থাপনা। এ ছাড়া দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনও এক ট্যুরে ঘুরে যাওয়া যায় কক্সবাজার এলে।