বাসস
  ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২৬

ভ্রমণ পিপাসুদের মন কাড়বে শেরপুরের গজনী অবকাশ কেন্দ্র

শেরপুর, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : শহুরে কোলাহল ও নাগরিক ব্যস্ততা থেকে একটু বিনোদন মানবজীবনে সকলের প্রয়োজন। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিবারসহ ঘুরে যেতে পারেন ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার গজনী অবকাশ কেন্দ্র থেকে।

শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশের পাদদেশে অবস্থিত সারি সারি শাল, গজারি, সেগুন, ছোট-বড় মাঝারি টিলা, লতাপাতার বিন্যাস যা প্রকৃতি ও পর্যটন প্রেমীদের মনে দোলা দিয়ে যায়।

তাই ভারত সীমান্ত ঘেষা উঁচু-নিচু পাহাড় বেষ্টিত এ পর্যটন কেন্দ্রে নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে শীতকালে বছরের শেষ বা নতুন বছরের শুরুতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ।

শেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়।

ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের প্রায় ৯০ একর পাহাড়ি এলাকা জুড়ে এর অবস্থান। গড়ে উঠার পর থেকেই প্রতিবছর ক্লান্ত জীবনের ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে অবসরে হাজারও পর্যটক ভিড় করেন এ গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।

গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যা যা দেখবেন :

শেরপুর জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড় তথা গজনী অবকাশের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়,গহীন জঙ্গল, টিলা, মাঝে-মাঝে সমতল। দু’পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে এগিয়ে চলা স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝর্ণা। পাহাড়, বনানী, ঝর্ণা, হ্রদ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনীতে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী) আপনাকে স্বাগত জানাবে, তারপর রয়েছে ডাইনোসরের বিশাল প্রতিকৃতি, ড্রাগন ট্যানেল, দণ্ডায়মান জিরাফ, পদ্ম সিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার, নিকুঞ্জ বন ও আলোকের ঝর্নাধারা। পূর্বে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানা থাকলেও নতুন করে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, হনুমান, গন্ধগোকুল, সজারু, কচ্ছপ, বাজপাখি, খরগোশ এবং ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণি।

শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে পাহাড়ের বুক জুড়ে তৈরি হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে যেখানে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। উঁচু পাহাড় কেঁটে তৈরি হয়েছে মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত। রয়েছে জিপ লাইনিংয়ের মত আধুনিক রাইড। এছাড়াও রয়েছে আগত শিশু দর্শনার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্ক, সেখানে ফ্লাইওভার গজনী এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিশু কর্নার, সুপার চেয়ার, নাগরদোলা ও মেরিগো। গজনী অবকাশে থাকছে শেরপুর জেলা র্ব্যান্ডিং কর্নার। ‘পর্যটনের আনন্দে তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর’ এ স্লোগানে শেরপুর জেলা র্ব্যান্ডিংয়ের জন্য নির্মিত র্ব্যান্ডিং কর্নারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিওচিত্র রয়েছে। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলসীমালা চালের জন্যও আছে আরেকটি আলাদা নির্দিষ্ট স্থান।

এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য নতুন তৈরি করা হয়েছে ক্যাবল কার। যা গজনী অবকাশে আগত ভ্রমণ পিপাসুদের বিনোদনের জন্য আলাদা মাত্রা যোগ করবে। এছাড়াও গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য ড্রাগন ট্যানেল।

অবকাশকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০ বর্গফুট উচ্চ এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পুরো গজনী অবকাশের পাহাড়ি টিলার অপরূপ সৌন্দর্যময় সবুজ দৃশ্য।

পাহাড়ী পরিবেশ গজনীতে শুধু ঘুরবেন কিছু কিনবেন না তা কি করে হয়। অবকাশ কেন্দ্রের ভিতরে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় অর্ধশতাধিক দোকান। যেখানে রয়েছে ছোট্র সোনামনিদের জন্য প্রায় সব ধরনের খেলনা, মহিলাদের জন্য সকল প্রকার আনকমন প্রসাধনী, চাদর, শাল, থ্রি-পিস, পুরুষদের জন্য বিভিন্ন রংয়ের পাঞ্জাবী, টুপি, সানগ্লাস, হর্সম্যান ক্যাপসহ রান্না-বান্নার কাজে প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র।

গজনী অবকাশ নতুন রূপে সজ্জিত হওয়া ও প্রশাসনের সহযোগিতার ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. তরফদার মাহমুদুর রহমান জানান, গারো পাহাড় ঘেরা গজনী অবকাশ ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের একটি অন্যতম জায়গা। তাই এর নিরাপত্তার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসন যথেষ্ট আন্তরিক। পুরনো আয়োজনের পাশাপাশি আগতদের জন্য নতুন নতুন আরও স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হচ্ছে।

প্রবেশ ফি :

গজনী অবকাশ কেন্দ্রে জনপ্রতি প্রবেশ ফি ২০ টাকা। ওয়াচ টাওয়ারের টিকেট মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা। গজনী অবকাশ কেন্দ্রে গাড়ী নিয়ে প্রবেশ করতে হলে উপজেলা পরিষদ চেকপোষ্ট থেকে গেটপাস নিতে হয়। বাস ও ট্রাকের জন্য ৩০০ টাকা, মাইক্রোবাস, পিকআপ ১৫০ থেকে ২০০ টাকা, জিপ, প্রাইভেট কার ১০০ টাকা এবং সিএনজির প্রবেশের জন্য ৫০ টাকা প্রদান করে গেটপাস নিতে হয়। এ গেটপাস সংরক্ষণ করে সীমান্তে বিজিবির নাকশী ক্যাম্পে গেটপাস দেখাতে হয়। এছাড়াও পার্ক এবং বিভিন্ন রাইডে চড়তে রাইডভেদে ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত লাগবে।

গজনীতে যেভাবে আসবেন :

ঢাকা থেকে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যেতে ময়মনসিংহ হয়ে যাতায়াত করা সবচেয়ে সুবিধাজনক। ঢাকার মহাখালি বাস স্ট্যান্ড থেকে ড্রিমল্যান্ড বা স্পেশাল বাসে করে শেরপুর আসতে জনপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া লাগবে। তবে মহাখালী থেকে দুপুর ২ টায় শেরপুর যাবার এসি বাস পাবেন, এসি বাসের ভাড়া জনপ্রতি ৬০০ টাকা। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত ট্রেনে আসতে পারেন। এরপর জামালপুর স্টেশন থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে শেরপুর-জামালপুর ব্রিজে আসতে হবে। পরে সিএনজি ও অটোরিকশায় করে শেরপুর আসা যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। জামালপুর থেকে শেরপুরের দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার এবং মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিটের পথ।

শেরপুর বাসস্ট্যান্ড হতে জনপ্রতি ১০ টাকা অটো রিকশা ভাড়ায় খোয়ারপাড় শাপলা চত্বর আসতে হবে। শাপলা চত্বরে গজনী-মধুটিলা যাওয়া অটো/সিএনজি রিজার্ভ পাওয়া যায়। সারাদিনের জন্য গজনী ও মধুটিলা ইকোপার্ক ঘুরে আসার অটোরিকশা বা সিএনজি  ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। প্রতি অটোরিকশায় ৬/৭ জন এবং সিএনজিতে ৫ জন উঠা যায়।

এছাড়া শেরপুর পৌরপার্ক থেকে মাইক্রোবাস বা প্রাইভেট গাড়ি রিজার্ভ করে গজনী অবকাশ কেন্দ্রে যেতে খরচ হবে ৩০০০ থেকে ৫০০০ টাকা। এছাড়া শেরপুর থেকে লোকাল বাসে করে ঝিনাইগাতী উপজেলায় এসে সেখান থেকে সিএনজি অথবা রিকশায়  গজনী অবকাশ কেন্দ্রে সহজে যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন :

ঝিনাইগাতীতে উপজেলা ডাকবাংলো এবং বনবিভাগের একটি রেস্ট হাউজ আছে। এগুলোতে পূর্ব অনুমতি নিয়ে থাকতে পারবেন। এছাড়া শেরপুর জেলায় ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় সাধারণ মানের গেষ্ট হাউজের পাশাপাশি ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বেশকিছু আধুনিক মানের হোটেল রয়েছে। পাশাপাশি শেরপুরে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, সার্কিট হাউজ, এলজিইডি, কৃষি ইনিস্টিটিউট এবং পল্লী বিদ্যুৎ এর পৃথক পৃথক রেষ্ট হাউজ রয়েছে। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের রেস্ট হাউসে শুধু মাত্র দিনের বেলায় বিশ্রাম নিতে চাইলে জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে প্রতিটি কক্ষের জন্য ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা ভাড়া দিতে হতে পারে।

এছাড়া ও যেসব জায়গায় থাকতে পারবেন। সার্কিট হাউজ ,এনডিসি জেলা প্রশাসন, শেরপুর। হোটেল সম্পদ প্লাজা, রঘুনাথ বাজার, শেরপুর। হোটেল অবকাশ, নিউ মার্কেট, শেরপুর । হোটেল আয়সার ইন ,রঘুনাথ বাজার, শেরপুর। হোটেল ফ্রিডম, শহীদ বুলবুল সড়ক, শেরপুর। আরাফাত গেস্ট হাউজ-, বটতলা, মেঘনা হল মার্কেট, শেরপুর।

কোথায় খাবেন :

খেতে চাইলে শেরপুর জেলা শহরের হোটেলগুলো সবচেয়ে ভালো। বিশেষ করে শহরের নিউ মার্কেট এলাকায় হোটেল শাহজাহান, হোটেল স্টার, আলীশান ছাড়াও হোটেল আহার, হোটেল মান্নান এবং হোটেল প্রিন্সে যেতে পারেন। এছাড়া ঝিনাইগাতী উপজেলা বাজারে হোটেল সাইদ ও হোটেল জোসনায় খাবার খেতে পারেন। পাশাপাশি  গজনী অবকাশে খাবারের হোটেল গুলোও বেশ উন্নত মানের ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে রয়েছে সাদা ভাত, ডিম, মুরগীর মাংস, গরুর মাংস, ছোট মাছসহ দেশীয় প্রায় সব ধরনের ভর্তা ও ভাজি।

পরামর্শ :

গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন। তাই কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে গহীন বন পেড়িয়ে সীমান্তের দিকে না যাওয়াই ভালো।