বাসস
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৪:৪৬

যশোরের মণিরামপুরে পাঁচ গ্রামজুড়ে নার্সারি ব্যবসা 

যশোর, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ (বাসস): জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে মণিরামপুর উপজেলার কুয়াদা বাজারে কাপড়ের ব্যবসা করতেন জামজামি গ্রামের আফিল উদ্দিন। কিন্তু এ ব্যবসা করে কোনভাবেই সংসার চালাতে পারছিলেন না। তাই কাপড়ের ব্যবসা বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ২০১৩ সালে। বাজুয়াডাঙ্গা গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী শাহাদত হোসেনের কাছ থেকে হাতে-কলমে নার্সারি ব্যবসার ট্রেনিং নেন। কাজ শেখার পর জামজামি গ্রামে বছরে ৬০ হাজার টাকা চুক্তিতে চার বিঘা কৃষি জমি লিজ নিয়ে শুরু করেন নার্সারি ব্যবসা। 

এখন আফিল উদ্দিনের নার্সারিতে ফলদ, বনজ, ঔষধী এবং ফুলের অন্তত ৫০ রকমের রেনু চারা আছে। যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পিকআপে করে রেনু চারা কিনে নিয়ে যান। আফিল উদ্দিন জানান, বছরে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেন তিনি। তা থেকে যে লাভ হয়, তাতে আগের চেয়ে এখন অনেক ভাল আছেন। 

আফিল উদ্দিনের মতো একই গ্রামে ১০ বিঘা জমিতে আব্দুল জব্বারের ‘খাইরুল নার্সারি’, ৩ বিঘা জমিতে আব্দুল মজিদ খানের ‘খান নার্সারি’, ৩ বিঘা জমিতে বিএম আরিফুজ্জামান রাসেলের ‘বনবিবি নার্সারি’, জালঝাড়া গ্রামে ১২ বিঘা জমিতে খালেদুর রহমান টিটোর ‘ভাইবোন’ নার্সারিও এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সফলতার সাথে নার্সারি ব্যবসা করে যাচ্ছেন। গ্রামজুড়ে কেবল নার্সারি আর নার্সারি। মাঠে নার্সারি, বাড়িতেও নার্সারি। 

কুয়াদা নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিএম আরিফুজ্জামান রাসেল বলেন, কুয়াদা বাজার সংলগ্ন বাজুয়াডাঙ্গা, জামজামি, বাহিরমানিক, ভোজগাতি ও জালঝাড়া গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষ নানাভাবে নার্সারি ব্যবসার সাথে জড়িত। এসব নার্সারি গুলোতে মূলত রেনু চারা উৎপাদন ও বিক্রি হয়। ফলদ, বনজ, ঔষধী, শোভাবর্ধণের তিন শতাধিক ভ্যারাইটির রেনু চারা এই গ্রামগুলো থেকে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতে যায়। এমনকি ফুলের রাজধানী হিসেবে খ্যাত যশোরের গদখালীতে যতো ফুলের চাষ হয়, সেসব ফুলের রেনু চারাও মণিরামপুরের এই পাঁচ গ্রাম থেকে যায়। নার্সারি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বছরে সব মিলিয়ে এই গ্রামগুলো থেকে ৫০ কোটি টাকার ওপরে রেনু চারা বিক্রি হয়। 

জালঝাড়া গ্রামের খালেদুর রহমান টিটো বলেন, ৮৪-৮৫ সালের দিকে সুইজারল্যান্ডের একটি এনজিও নার্সারি ব্যবসায়ীদের একত্রিত করে একটা সমিতি করে দেয়। পরে এই সমিতির সদস্যদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি কাঠজাতীয় গাছের চারা প্রদান করে। ওই প্রশিক্ষণে কুয়াদা এলাকার ৪০ জন অংশ নিয়ে নার্সারি ব্যবসায় সফলতা অর্জন করেন। পরে তাদের দেখে গ্রামের অন্যরাও এই কাজ শুরু করেন। এভাবে আশপাশের পাঁচগ্রামে নার্সারি ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে। 

আফিল নার্সারির মালিক আফিল উদ্দিন বলেন, তাদের কাছ থেকে রেনু চারা কিনে নিয়ে অনেকেই দুবাই, ওমান, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। তাদের উৎপাদিত পেয়ারা, আমকুল ও হাইব্রিড আমড়ার চারা ভারতে যাচ্ছে অহরহ। আবার ভারত থেকে আপেল, আঙ্গুর, মাল্টা, অ্যাভোকাডো, পার্সিমন, নাশপাতিসহ শতাধিক ফল, ফুল ও শোভাবর্ধণ গাছের চারা আমদানিও করতে হচ্ছে। 

ভাইবোন নার্সারির মালিক খালেদুর রহমান বলেন, ‘যে কোন নতুন ভ্যারাইটি থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সবার আগে ভারত সংগ্রহ করে। সেখানে তারা চারা বানিয়ে আবার বিভিন্ন দেশে পাঠায়। নতুন ভ্যারাইটি আমাদের দেশে নানান সমস্যার কারণে আনতে পারিনা। সে কারণে ভারত থেকেই চারাগুলো আনতে হয়’। তিনি বলেন, সরকার যদি যে কোন নতুন ভ্যারাইটি দেশে আনার বিষয়টি সহজ করে দেয় এবং এখানকার নার্সারি মালিকদের রপ্তানিযোগ্য রেনু চারা উৎপাদনের ওপর কার্যকর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, তাহলে রেনু চারা রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আফিল নার্সারির মালিক আফিল উদ্দিন বলেন, মণিরামপুর উপজেলার কৃষি অফিস থেকে আমাদের কয়েকবার ডেকেছিল। সারাদিন বসিয়ে রেখে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তারা কী বলেন, আমরা কিছুই বুঝি না। এরপর আর ডাকলেও আমরা যাই না। 

মণিরামপুর উপজেলার অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা শারমিন শাহানাজ বলেন, নার্সারি মালিকদের জন্য কৃষি অফিস থেকে আলাদা কোন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নেই। যদি এ ব্যাপারে কোন প্রকল্প হয়, তাহলে ট্রেনিং দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, এটা হর্টিকালচারের বিষয়। যশোরে একটি পূর্ণাঙ্গ হর্টিকালচার সেন্টার আছে। সেখান থেকে হয়তো কিছু করা সম্ভব। যশোর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক দীপঙ্কর দাশ বলেন, নার্সারি মালিকদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কোন প্রকল্প নেই। তবে সরকার যদি চায় তাহলে রফতানীযোগ্য রেনু চারা উৎপাদনের বিষয়ে নার্সারি মালিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।