বাসস
  ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৫

বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহান আলীর মাজার অনন্য স্থাপত্য নির্দশন

আজাদ রুহুল আমিন

বাগেরহাট, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : জেলার ষাট গম্বুজ, মজজিদ ও খানজাহান আলীর মাজার অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন । এসব নিদর্শন দেশি বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত খান উল আজম উলুঘ খান ই জাহানের (খান জাহান) প্রতিষ্ঠিত খলিফাতাবাদ রাজ্যের রাজধানী ছিল বাগেরহাট। ১৫'শ শতাব্দীর প্রাচীন রাজ্য ছিল এটি। প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর বাগেরহাটের নাম আসলেই প্রথমে মাথায় আসবে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাট গম্বুজ মসজিদ ও খান জাহানের মাজারের কথা।

ষাটগম্বুজ মসজিদ:

ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন। বাগেরহাট শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি না থাকায় এর নির্মাণকাল ও নির্মাতার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে নির্মাণশৈলী দেখে ধারণা করা হয় এটি ১৫শ শতাব্দীতে খান জাহানের আমলে তৈরি। এ মসজিদটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর একটি চমৎকার নিদর্শন। নাম ষাট গম্বুজ হলেও বাস্তবে মসজিদটির ছাদে ৭৭টি ছোট গম্বুজ এবং কেন্দ্রে চারটি বৃহৎ গম্বুজসহ মোট ৮১ টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো অত্যন্ত সুদৃঢ়। ৬০টি পাথরের স্তম্ভের উপর এ মসজিদটি স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। ষাট গম্বুজ মসজিদের পাশেই রয়েছে 'ঘোড়া দীঘি' । জানা যায়, খান জাহান ঘোড়ার পিঠে চড়ে এ দীঘি খননের তদারকি করতেন, সে কারণেই নাম ঘোড়া দীঘি। আবার এমন কথিত রয়েছে যে, একটি ঘোড়ার পিঠে বসে একবার চাবুক মেরেছিলেন খান জাহান। সেই এক চাবুকে ঘোড়া যতদূর দৌড়েছিলো, ততটুকু জায়গায় দীঘি খনন করা হয়। সে কারণেই এ দীঘির নাম হয়েছে ঘোড়া দীঘি। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ষাট গম্বুজ মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ষাট গম্বুজ মসজিদে প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক দেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৫০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহের পর্যটকদের জন্য টিকেট মূল্য ২০০ টাকা। একই টিকেটে ষাট গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ রয়েছে। এ জাদুঘরে বর্তমানে খান জাহান সময়কালীন বহু নিদর্শন রয়েছে।

খান জাহান নির্মিত প্রাচীন রাস্তা :

রাস্তাটির অবস্থান বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাট গম্বুজ ইউনিয়নের মগরা গ্রামে। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার উত্তর এবং খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তর দিকে রাস্তাটির অবস্থান। বর্তমানে এ রাস্তার বেশিরভাগ অংশ হারিয়ে গেছে, তবে ইট দ্বারা নির্মিত খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা এবং সেতুসহ প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা এখনও টিকে আছে। এ স্থাপনাও ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত এ রাস্তাটির অস্তিত্ব ছিল। তবে প্রাকৃতিক কারণে এটি বিলীন হয়ে যায়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার এ প্রাচীন রাস্তাটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। রাস্তাটি সম্পর্কে তেমন প্রচার না থাকায় এখানে দর্শনার্থীরা আসেন না বললেই চলে। 

খান জাহানের বসতভিটা :

ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ মিটার দূরে অবস্থিত খান জাহানের বসতভিটা। খান জাহানের নির্মিত প্রাচীন রাস্তাটিও মূলত এসে এখানেই মিলেছে। এখানে বিশাল একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এখনো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। ধারণা করা হয়, এখানেই ছিলো খান জাহানের বসতবাড়ি। এছাড়া বেশ কিছু ঢিবি আছে এখানে। সেগুলো মূলত এ প্রাসাদেরই ধ্বংসাবশেষ। ২০০১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথমবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করে এ ঢিবিটিতে। এরপর ২০০৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোট ১২টি খননে এখানে প্রাচীন দেয়াল, মেঝে, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর নালা, পোড়ামাটির তৈরি পাইপসহ নানা স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে।

এর মধ্যে রয়েছে প্রদীপদানি, তরবারি, পোড়ামাটির পুঁতি, লাল, কালো ও ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র, প্লেট, গ্লাস, পিরিচ, নল, জালের গুটি, অলংকৃত ইটসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু। এছাড়া, এখানে পাওয়া স্থাপত্য, মৃৎপাত্র, তৈজসপত্র ও উপকরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তখনকার সময়ে এখানে বসবাসকারীদের রুচিবোধ ছিল অত্যন্ত উন্নত। তাদের নির্মাণশৈলী ও শৈল্পিকতার প্রকাশ মেলে এসব নিদর্শনে। খানজাহানের বসতভিটা এখন বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।

খান জাহানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স :

প্রাচীন খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান জাহান (র) এর মাজারটি ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এ কমপ্লেক্সটি একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রায় সারা বছরই এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। বছরে দুবার সমাধি কমপ্লেক্সে ওরশ ও বার্ষিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। খান জাহানের সমাধির পশ্চিম দিকে তার প্রধান সহচর মুহাম্মদ তাহিরের সমাধি, এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও খান জাহানের অন্যান্য উত্তরসূরীদের সমাধি রয়েছে। কমপ্লেক্সটি ৬৭.১ মিটার পূর্ব-পশ্চিম এবং ৬৪.৭ মিটার উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বেষ্টনিতে ঘেরা। 

খান জাহান আলীর সমাধিসৌধটি বাইরের দিকে ১৩.৭ মিটার এবং ভেতরের দিকে ৯.১ মিটার বিস্তৃত। এটি প্রাচীন ইটের নির্মিত একটি বর্গাকার ভবন, যার চারপাশে চারটি গোলাকার পিলার রয়েছে। খান জাহান আলীর কবরের উপর আরবি ও ফারসি লিপি খোদিত রয়েছে, যদিও অধিকাংশ লেখাই এখন অস্পষ্ট।

কমপ্লেক্সের পাশেই মুহাম্মদ তাহিরের সমাধি, যা তিন স্তরবিশিষ্ট পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাহির ছিলেন খান জাহানের প্রিয় কর্মকর্তা।

 

কিভাবে যাবেন?

প্রাচীন খলিফাতাবাদ রাজ্যের এতসব সমৃদ্ধ স্থাপনা ও স্থান একদিনের মধ্যেই ঘুরে ফেলা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রথমেই আসতে হবে বাগেরহাটে। ঢাকা থেকে ৬৫০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে এসি/নন এসি বাসে চলে আসতে পারেন বাগেরহাটে। নামতে পারেন বারকপুর স্টপেজে। সেখান থেকে ভ্যানে চুনাখোলা মসজিদ ও বিবি বেগনী মসজিদ ঘুরে সোজা চলে যেতে পারেন ষাটগম্বুজ মসজিদে। মাত্র ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই সকল পুরাকীর্তি রয়েছে। চাইলে স্থানীয় অটোরিকশায় করে ঘুরতে পারেন বিভিন্ন স্থাপনায়। খরচ হতে পারে জনপ্রতি ৩ থেকে ৪ শ টাকা।

কোথায় থাকবেন?


প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাগেরহাট জেলাটি পর্যটকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখানে ভালো মানের হোটেল নেই। এখান থেকে খুলনা মাত্র ১৫ কিলোমিটার তাই পর্যটকরা চলে যান রাত কাটাতে রয়্যাল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সিটি ইন, ক্যাসেল সালাম, হোটেল পার্কসহ অভিজাত আরও অনেক আধুনিক আবাসিক হোটেল রয়েছে। তবে বাসসকে ষাটগম্বুজ জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান জানান, এ ক্যাম্পাসে আবাসিক গেস্ট হাউজ এসি সিংগেল ৭ শ টাকা ডাবল বেড ১৪ শ টাকা। বাজার করে দিলে বাবুর্চি রান্না করে পরিবেশন করলে তাকে কিছুটা খুশি করলেই সন্তুষ্ট সরকারি ভাবে বাবুর্চি নিয়োগ না থাকায় পর্যটকদের সেবায় এ ব্যবস্থা নেয়া। এখানে অবস্থান নিতে গেলে গেস্ট হাউজ ইনচার্জ আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই চলবে।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক আহমেদ কামরুল হাসান জানান, পর্যটকদের স্বার্থে পর্যটন কর্পোরেশন ইতোমধ্যে পাঁচতলা বিশিষ্ট আধুনিক ভবন নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্নের পথে। এ ছাড়াও বাগেরহাটে ধানসিঁড়ি, লেক ফুজি, আল আমিন বাসস্ট্যান্ডের কাছে দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। খানজাহান আলি মাজার সংলগ্ন হোটেল জারিফ, হোটেল অভিসহ বেশ কিছু মাঝারি ধরনের আবাসিক থাকা খাওয়ার সুলভ মূল্যে সার্বিক ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি ভাবে সার্কিট হাউস, গণপূর্ত, এল জি ইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক জনপথ বিভাগের বেশ কিছু গেস্ট হাউজ রয়েছে। বেসরকারি কোডেকের আবাসনটি অনেক অভিজাত। এখানকার আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে বাগেরহাট পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ জানান, সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা সার্বিক নজরদারি করে থাকে। স্টাইকিং ফোর্স পালাক্রমে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়ে ঘিরে রাখেন।

কি খাবেন?

বাগেরহাটে খাওয়ার জন্য বেশ কিছু মাঝারি মানের রেস্টুরেন্ট আছে। স্থানীয় সেয়াই পিঠা ও হাঁসের মাংস বাগেরহাটে বিখ্যাত। এছাড়া গরুর মাংস ও চুইঝালের খ্যাতিও রয়েছে দেশজোড়া। একই সঙ্গে চিংড়ির স্বাদ নিতে ভুলবেন না। খান জাহান মাজারের মোড়, এবং ষাটগম্বুজ মসজিদের আশেপাশে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এসব স্থানীয় খাবার সেসব হোটেল রেস্তোরাঁয় পেয়ে যাবেন।