বাসস
  ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:০৮
আপডেট : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:১৭

বগুড়ার পর্যটন সম্ভাবনাময় দর্শনীয় স্থান

//আবুল কালাম আজাদ//

বগুড়া, ২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : প্রাচীন কাল থেকেই বগুড়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা অর্থনীতির হিসাবের খাতা বেশ মজবুত শুধু দেশে নয়, বিশ্ব দরবারেও বগুড়া হাজির হয়েছে নিজের মতো করেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের ক্ষেত্রেও আশাজাগানিয়া ঐতিহাসিক নগরায়ণ ঘটেছে বগুড়ায়। এখানে পর্যটন শিল্পকে ঘিরে ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে।

বগুড়ার পর্যটন সম্ভাবনাময় দর্শনীয় স্থান।

মহাস্থানগড়:

বগুড়া শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়া-ঢাকা বিশ্বরোডের পাশে মহাস্থানগড় অবস্থিত। ঐতিহাসিকদের মতে, করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এখানে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে। পরে হজরত শাহ্ সুলতান বলখী (রহ.) মাহী সওয়ারের মাজারকে কেন্দ্র করে এখানে প্রাণের সঞ্চার ঘটে। প্রতিদিন এলাকাটি ঘিরে ইতিহাসবিদ কিংবা দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে। শহরের সাতমাথা থেকে অটোরিকশায় করে জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারেন স্থানটি।

মহাস্থানগড়ে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে গোকূল মেধ বা বেহুলার বাসর ঘর সর্বাধিক পরিচিত। এ ছাড়াও রয়েছে শাহ সুলতানের মাজার, খোদার পাথর ভিটা, জিয়ৎ কুর, ভাসু বিহার, গোবিন্দ ভিটা, প্রত্নতাত্মিক জাদুঘর, শীলাদেবীর ঘাট, মানকালীর কুর, পশুরামের প্রাসাদ মশলা গবেষণাকেন্দ্র।

এসব জায়গা দেখতে হলে আপনাকে দিনের অর্ধেক সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে। বগুড়া শহর থেকে মহাস্থানে যেতে যোগাযোগের তেমন সমস্যা নেই। তবে এখানে নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন এখানে ঘুরতে আসা পর্যটকেরা।

মহাস্থানগড়ে পাবেন বগুড়ার বিখ্যাত খাবার চালের কটকটি। এখানে বছরে প্রায় ৫০ কোটি টাকার কটকটি বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। জেলা শহরের দত্তবাড়ি থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশায় করে মহাস্থানে যাওয়ার জন্য মাত্র ৩০ টাকা ভাড়ার প্রয়োজন হয়।

বিরল পারুল গাছ :

জেলার  সোনাতলা উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি নাজির আখতার কলেজ চত্ত্বরে দাঁড়িয়ে আছে বিরল বৃক্ষ পারুল। বিরল বলছি এ কারণে যে সুদূর অতীতে ভূভারতে তথা বঙ্গদেশে দু-একটি পারুল গাছ থাকলেও তা আজ বিলীন। ৪০৫০ ফুট উঁচু গুল্মজাতীয় এ গাছ সারা দেশেই বিরল বলে জানিয়েছেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও বৃক্ষ গবেষকেরা।

বগুড়া শহরের চেলোপাড়া থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ৬০ থেকে ৭০ টাকায় সোনাতলায় গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। জেলা শহর থেকে সোনাতলা উপজেলা দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার হলেও এখানে চলাচলের জন্য ভালো যানবাহন হলো অটোরিকশা।

এখানে আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালুর দাবি অনেকদিনের। প্রেম যমুনার ঘাট: জেলা সারিয়াকান্দি প্রেম যমুনার ঘাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বেশকিছু দৃষ্টিনন্দন কাজ করা হয়েছে। এতে এই পর্যটন কেন্দ্র এখন নতুন রূপ ধারণ করেছে। বাড়ছে পর্যটকদের সংখ্যা। উপজেলার যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে যে কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো সদর ইউনিয়নের দীঘলকান্দি গ্রামের প্রেম যমুনার ঘাট। এখানে প্রতিনিয়ত শত শত পর্যটকের আগমন ঘটে। তাই স্থানীয় তরুণ-তরুণীরা পছন্দের এই স্পটের নামকরণ করেন প্রেম যমুনা ঘাট, যা উপজেলার মধ্যে অন্যতম পর্যটন স্পট হয়ে ওঠে। গত কয়েকদিন আগে এই প্রেম যমুনার ঘাটে পর্যটকদের বসার জন্য ৮টি ছাউনিসহ বেঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। বগুড়ার চেলোপাড়া থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ৫০ থেকে ৬০ টাকায় সারিয়াকান্দি উপজেলায় যাওয়া যায়। এরপর অটোরিকশায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা ভাড়া দিয়ে যাওয়া যায় প্রেম যমুনার ঘাটে। কয়েক বছর আগে জেলা থেকে সারিয়াকান্দি উপজেলায় বাস চলাচল করলেও এখন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ রয়েছে। এ পথেও আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস চালুর দাবি স্থানীয় বাসিন্দাসহ পর্যটনকদের।

খেরুয়া মসজিদ:দেশের বগুড়া জেলায় বাংলার প্রাচীনতম একটি সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। মহাস্থানগড়সহ বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় এ অঞ্চলজুড়ে। এর মধ্যে অন্যতম একটি নিদর্শন হলো খেরুয়া মসজিদ। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরোনো এই মসজিদ বগুড়ার শেরপুর উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে খন্দকারটোলা গ্রামে অবস্থিত। মসজিদের চারপাশ সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। আশপাশটা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। বগুড়া থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে শেরপুরে ঘুরে দেখতে পারেন দর্শনীয় স্থান খেরুয়া মসজিদ। শেরপুর উপজেলায় বাস থেকে নেমে অটোরিকশা বা রিকশাযোগে যেতে হয়। উপজেলা শহরের বাহিরে হলেও এখানে তুলনামূলকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো।

ভাসু বিহার:

জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থানগড় থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বিহার গ্রামে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ভাসু বিহার অবস্থিত। স্থানীয় বাসিন্দারা নাগর নদীর পশ্চিমের এই জায়গাটিকে নরপতির ধাপ হিসেবে চিনেন। ভাসু বিহার থেকে গুপ্তযুগের দুইটি আয়তাকার বৌদ্ধ বিহার ও ক্রুশাকৃতি মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ভাসু বিহারে প্রথম খনন কাজ করা হয়। খননের মাধ্যমে এখান থেকে দুইটি মধ্যম আকৃতির সংঘরাম, একটি মন্দিরের আংশিক অবকাঠামো এবং প্রায় ৮০০ টির মতো মুল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়। জেলা থেকে ভাসু বিহারের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। জেলা শহর থেকে সিএনজি বা অটো রিকশায় গোকুল মেধ রোড দিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ স্কোয়ারে ঢুকে ভাসু বিহার যাওয়া যায়। এটিই ভাসু বিহারের যাওয়ার একমাত্র ভালো যান।

রানী ভবানীর বাপের বাড়ি:

জেলার সান্তাহারের ছাতিয়ান গ্রামে রানী ভবানীর জন্মগ্রহণ করেন। সংস্কার এবং সংরক্ষণের অভাবে রানী ভবানীর (বাপের বাড়ি) আজ ধ্বংসের পথে।প্রচলিত আছে সপ্তদশ শতাব্দীতে ছাতিয়ান গ্রামের জমিদার আতারাম চৌধুরী ছিলেন নিঃসন্তান। আতারাম চৌধুরী সন্তান লাভের আশায় বাড়ীর কাছে নির্জন পুকুর পাড়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা-অর্চনা করেন। পরবর্তীতে তার স্ত্রীর গর্ভে ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হলে তার নাম রাখা হয় ভবানী। জমিদার যেস্থানে সাধনা করে সিদ্ধি লাভ করেন সে জায়গাটি সিদ্ধেশ্বরী নামে পরিচিত হয়ে উঠে।সান্তাহার থেকে মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় রানী ভবানীর বাবার বাড়ি দেখতে যেতে পারবেন।

বেহুলার বাসরঘর:

শহর থেকে ১১ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে আর মহাস্থানগড়ের কাছে গোকুল, রামশহর ও পলাশবাড়ি গ্রামের সংযোগস্থলেই রহস্যময় ও বিস্ময়কর ‘তিন কোণ’ বিশিষ্ট স্থাপত্য বেহুলার বাসরঘরের অবস্থান।স্থাপত্যটি গোকুল মেধ বা লক্ষীন্দরের মেধ বলেও পরিচিত। স্থানীয়রা এই নিদর্শনাকে বেহুলার বাসরঘর বলে থাকলেও ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ। বেহুলার বাসর ঘরে যাওয়ারও একমাত্র উপায় হলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তবে স্থানীয় প্রশাসন চাইলে এ পথে বাস যোগাযোগ করতে পারে বলে মনে করেন সম্প্রতি নাটোর থেকে ঘুরতে আসা তাবাসসুম মারিয়া।

সান্তাহার জংশন :

শুরুর দিকে স্টেশনটির নাম সুলতানপুর থাকলেও ১৯৪৭ সাল থেকে সুলতানপুর বদলে এটি সান্তাহার নামে বেশি পরিচিত হয়ে উঠে। কথিত আছে, সান্তাহার রেলওয়ে জংশনের কাছাকাছি সাঁতাহার নামক স্থান থেকেই এ নামের উৎপত্তি। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলায় অবস্থিত সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশন একটি জংশন স্টেশন।

বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ জংশন স্টেশন দিয়ে প্রতিদিন কয়েকশ যাত্রী চলাচল করেন।

এ স্টেশন দিয়ে দৈনিক যাত্রী ও পণ্যবাহী প্রায় ৩০টি ট্রেন চলাচল করে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রেলইয়ার্ডটিও সান্তাহার জংশন স্টেশনে অবস্থিত। জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে হলেও বাস যোগাযোগ খুব ভালো।

এর বাহিরে বগুড়ায় মম ইন ইকো পার্ক পর্যটকদের জন্য বেশি কিছু সম্ভবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। এখানে শিশুদের জন্য নাগরদোলা, খেলার মাঠ, মটকা চা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, গাছপালা সবাইকে আকৃষ্ট করে। দিন দিন পর্যটকদের কাছে এই জায়গাটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। তবে এখানে প্রবেশ মূল্য রয়েছে। জন প্রতি প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা। এর পাশেই গড়ে উঠেছে পাচ তারকা হোটেল মম ইন। এই হোটেলে মধ্যে সপ্তাহের একদিন প্রবেশ করতে জন প্রতি ২০০ টাকা লাগে। এটি বগুড়া শহর থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে অবস্থিত।

ঢাকার গাবতলী বা মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি বাসে এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে বগুড়া শহর যেতে পারেন। বাসে নন-এসিতে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা ও এসিতে ১২৫০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা ভাড়া। ট্রেনে গেলে যেতে পারেন আন্ত:নগর রংপুর এক্সপ্রেস বা লালমনি এক্সপ্রেসে।

বগুড়ায় থাকতে পারবেন হোটেল মম ইন (ফাইভ স্টার মানের), হোটেল নাজ গার্ডেন (ফোর স্টার মানের), পর্যটন মোটেল (বনানী মোড়ে), শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রোচাস হোটেল, সেফওয়ে মোটেল (চারমাথা), নর্থওয়ে মোটেল (কলোনী বাজার), সেঞ্চুরি মোটেল (চারমাথা), মোটেল ক্যাসল এমএইচ (মাটিডালি) ইত্যাদি জায়গায়। এগুলো প্রত্যেকটাই শহরের নিরিবিলি পরিবেশে। এসব হোটেলে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার টাকায় থাকতে পারবেন। দইয়ের শহর বগুড়ায় এসে এশিয়া, চিনিপাতার দই-মিষ্টি আর কলোনির চুন্নুর গরুর চাপ খেতে পারেন।