বাসস
  ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৬

সুনামগঞ্জে ৪ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী

সুনামগঞ্জ, ৪ জানুয়ারি ২০২৫(বাসস) : হাওর বেষ্টিত বোরো প্রধান এ জেলায় সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ১২০ হেক্টর জমি। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এ বছর সরিষা চাষ করা হয়েছে ৪ হাজার ১৪৮ হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিকটন সরিষা।  

জেলার সবুজ মাঠ ছেঁয়ে গেছে মনোমুগ্ধকর হলুদ সরিষা ফুলে। সরিষার ফুলে সুনামগঞ্জের কৃষকেরা এখন স্বপ্ন  দেখছেন সরিষার বাম্পার ফলনের ।

কৃষকরা অধিক ফলনের সঙ্গে লাভবান হতে সরিষার  ক্ষেতে সময় দিয়ে যাচ্ছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, এবার ফুল ভালো ধরায় সরিষার বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে।

কৃষকরা বলছেন, দিগন্তজোড়া মাঠে মাঠে সরিষা ফুলের সমারোহ দেখা যাচ্ছে। জেলার প্রতিটি উপজেলায় এখন সরিষা ফুলের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে। দূর থেকে মনে হবে পুরো এলাকা জুড়ে হলুদ গালিচা বিছানো। কুয়াশা ভেজা মাঠে হিমেল হাওয়ায় হলুদ ফুল গুলো দোল খেলছে। কুয়াশার জলরাশি ভেদ করে সবুজ মাঠের দেশে এখন হলুদের সমারোহ।

কৃষকরা ছুটছেন লাভজনক তেল জাতীয় ফসল সরিষা চাষের দিকে। কম খরচ, কম পরিশ্রম আর অল্প সময়ে সরিষা চাষ করা যায় বলে এটি অত্যন্ত লাভজনক একটি ফসল। পতিত বিঘা জমি থেকে চলতি মৌসুমে গড় ৪  থেকে ৫ মণ হারে সরিষার ফলন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও সরিষা চাষ করলে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। যার কারণে প্রতি বছরই সরিষার চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সুনামগঞ্জে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮ হেক্টর বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে সরিষার। ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেলের চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাম বেশি হওয়ায় আগ্রহ  বেড়েছে কৃষকদের। অন্যান্য ফসলের তুলনায় সরিষা চাষে কম খরচ, কম শ্রম এবং দ্রুত ফলন পাওয়া যায়। যে কারনে চাষিরা আবাদে লাভ বেশি পায়।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে যেসব উপজেলায় সরিষা আবাদ করে থাকেন কৃষকরা। উপজেলা গুলো হচ্ছে ধর্মপাশা, তাহিরপুর, ছাতক, সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারা বাজার, জগন্নাথপুর, দিরাই, জামালগঞ্জ, শাল্লা ও শান্তিগঞ্জ উপজেলায়। জেলায় ১২টি উপজেলা হলেও ধর্মপাশা উপজেলাকে ভাগ করে নতুন মধ্যনগর উপজেলা সৃজন করায় কৃষি বিভাগ এখন মধ্যনগর উপজেলার চাষাবাদের হিসাবে ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যে দেখানো হয়েছে। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আরো জানায়, জেলার ধর্মপাশা উপজেলায় এবছর সরিষা চাষাবাদ হয়েছে ৭২০ হেক্টর, তাহিরপুর উপজেলায় ৬৪৫ হেক্টর, ছাতক উপজেলায় ৪৩০ হেক্টর, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় ৪২০ হেক্টর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ৪১৫ হেক্টর, দোয়ারা বাজার উপজেলায় ৩৯৫ হেক্টর, জগন্নাথপুর উপজেলায় ৩০৫ হেক্টর, দিরাই উপজেলায় ২৮৫ হেক্টর, জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৫৭ হেক্টর, শাল্লা উপজেলায় ১৭০ হেক্টর এবং শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ১৪২ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এক বিঘা মানে (৩৩ শতক) এবং কেদার মানে (৩০ শতক)। এক হেক্টর মানে সাড়ে ৭ বিঘা এবং ২ দশমিক ৪৭ একর মানে এক একর। সুনামগঞ্জে স্থানীয়রা জমির হিসাবকে কেদার হিসেবে বুঝেন।

আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জ জেলায় সরিষার বাম্পার ফলনের আশা করছেন করছেন কৃষকরা। সরিষার দামও ভালো পাওয়ার আশা করছেন তারা।

জেলার  বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের মাছিমপুর গ্রামের সরিষা চাষী সাইদুর রহমান বাসসকে জানান, এ বছর তিনি ২২ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। আর একমাস পরে সরিষা গোলায় তুলার পর ওই জমিতে স্কিমের বোরো ধান করবেন ( ডিপ নলকূপ দিয়ে যে বোরো জমি চাষ করা হয় তাকে স্কিমের বোরো জমি বলে)। 

তিনি আরো জানান, সরিষা ফুল ছেড়েছে। ফুল দেখে বুঝা যাচ্ছে এ বছর ফলন ভালো হবে।

জগন্নাথপুর উপজেলার কলকলি ইউনিয়ের মজিদপুর গ্রামের কৃষক মুজিবুর রহমান বাসসকে জানান, গত বছর তিনি ১৫ কেদার জমিতে সরিষা চাষ করে ভালো ফলন পাওয়ায় এ বছর তিনি ৫০ কেদার (বিঘা) জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। তিনি আরো জানান,  তিনি মাত্র আড়াই কেদার জমির মালিক। গ্রামের লোকদের কাছ থেকে বাকি জমি নিয়ে তিনি সরিষা চাষ করেছেন। সরিষা গোলায় তোলার পর জমির মালিকরা যদি তাকে চাষাবাদের জন্য জমি দেন তাহলে তিনি ওই জমিতে ধান চাষ করবেন।

তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের মোকছেদপুর গ্রামের সরিষা চাষী সুলেমান মিয়া বাসসকে জানান, এ বছর তিনি ৬ কেদার জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। কৃষি অফিসের সহায়তায় ৭ জনের গ্রুপ করে আরো ৬ কেদার জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। তিনি জানান, প্রতি কেদার জমিতে অন্তত ৫ মণ করে সরিষা ফলবে। 

সুলেমান বাসসকে আরো জানান, সরিষা ভাঙ্গিয়ে তিনি নিজের পরিবারের জন্য তেল সংগ্রহ করেন। প্রতি মণ সরিষা ভাঙ্গালে অন্তত ১৯ থেকে ২০ লিটার তেল হয়।

এ বছর সরিষা ভালো ফলন হয়েছে। ভালো ফলনের কারণে তিনি এবং তার গ্রুপের কৃষকরা খুব খুশি বলেও জানান কৃষক সুলেমান।

ধর্মপাশা উপজেলার বংশিকুন্ড ইউনিয়নের হামিদপুর গ্রামের কৃষক অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো. শহীন মিয়া বাসসকে জানান, তিনি ২০১৭ সালের জুনে অবসরে আসেন। এরপর থেকে নিজে জমি চাষাবাদ করতে শুরু করেন। এ বছর তিনি ৬ কেদার (বিঘা) জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। তিনি আরো জানান, ফলন ভালো হয়েছে। প্রতি কেদারে(বিঘা) অন্তত ৫ মণ করে সরিষা হবে। সরিষা তোলার পর তিনি ওই জমিতে ইরি ধান চাষ করবেন।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বাসসকে জানান, সুনামগঞ্জ জেলায় সরিষা নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বপন শুরু হয়ে চলে ডিসেম্বর মাসে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। সংগ্রহ শুরু হয় ২০ জানুয়ারি থেকে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত।

তিনি আরো জানান, সরিষা বপনের ৮০ দিন থেকে ৮৫ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করতে পারেন কৃষকরা।

বিমল চন্দ্র সোম আরো জানান, সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সরিষা থেকে ভালো তেল উৎপাদন হয়। এটা অত্যন্ত লাভ জনক হওয়ায় হাওর অধ্যুষিত এ জেলায় বেশি সরিষা চাষাবাদ হয়েছে।