শিরোনাম
চট্টগ্রাম, ৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেছেন, সাংবাদিকতা পেশায় রাজনৈতিক দলবাজি বন্ধ করা দরকার যা পেশার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দলীয় রাজনীতির আদর্শ থেকে খবর সেন্সর করা অথবা বিকৃত করার প্রয়াস সাংবাদিকতাকে প্রভাবিত করছে।
আজ রোববার (৫ জানুয়ারি) চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগের সাংবাদিকদের সাথে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের মতবিনিময় সভায় সভাপতির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়ে সভায় কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘নীতিগতভাবে বা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈষম্য করা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বৈষম্যের শিকার ব্যক্তি বা সাংবাদিকদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এটা আমাদেরকে বিবেচনায় নিতে হবে। একইভাবে হয়রানিমূলক মামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, জেল খেটেছেন, দিনের পর দিন কাজ করতে পারেননি, তাদের মামলা প্রত্যাহারের বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতেই বিবেচনা করা দরকার। আর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবিটাও যৌক্তিক ও ন্যায্য।’
তিনি বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিক) বক্তব্যে রাজনৈতিক সক্রিয়তা, দলীয় সক্রিয়তা, ফ্যাসিবাদের সহযোগিতা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যারা ফ্যাসিবাদে সহযোগিতা করেছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন ওঠেছে। তাদের যারা উস্কানি দিয়েছেন তাদের বিচারের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। সমস্যা হলো আমরা কোনো তদন্ত সংস্থা নই। অপরাধগুলোর তদন্ত আমরা করতে পারব না। তবে আমরা এটা বলতে পারি, যারা উস্কানিদাতা তাদের উস্কানির বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
ওয়েজবোর্ডের বদলে সাংবাদিকদের একটা ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ করার প্রস্তাবের বিষয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান বলেন, ‘সেটা একটা ভালো সমাধান হতে পারে যে, ন্যূনতম বেতন সারাদেশে সাংবাদিকদের জন্য থাকবে। যে শহরে খরচ বেশি, বিশেষ করে ঢাকায়-আলাদা করে একটা ভাতা বা বাড়তি বেতন দিতে হবে।
আমরা আশা করছি এই ধরনের সমাধানগুলো আমরা আপনাদের কাছ থেকেই পাব। সেটার ভিত্তিতেই আমরা সুপারিশমালা তৈরি করব। বাস্তবায়ন সরকার করবে, সেটি আমাদের হাতে নেই। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও তাদের সুপারিশ লিখিতভাবে চেয়েছি।’
সম্পাদকদের জন্য নীতিমালা হওয়া দরকার জানিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘আমরা সম্পাদক পরিষদকে বলেছি, একটা জাতীয় নীতিমালা হওয়া দরকার। আপনারা একটা মান নির্ধারণ করেন যে, এই ন্যূনতম মান আমাদের মেনে চলা দরকার। আশা করছি সম্পাদক পরিষদ সেই উদ্যোগটা নেবেন।’
পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদকদের যোগ্যতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে যোগ্যতার প্রশ্ন, পেশাদার সাংবাদিকের সম্পাদক হওয়ার প্রশ্ন- এগুলো কিন্তু নীতিমালায় আছে। কিন্তু আপনারাই বলছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবারের সদস্যদের সম্পাদক বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেটা আবার সরকার গ্রহণ করছে। কারণ হতে পারে রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা অন্য কিছু।’
ডিএফপি কর্তৃক পত্রিকার প্রচার সংখ্যার অবাস্তব তথ্য প্রসঙ্গে কমিশন প্রধান বলেন, ‘একইভাবে পত্রিকার প্রচার সংখ্যার দিক থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের নামেই চারটি পত্রিকার ডিক্লারেশন ছিল। একটি পত্রিকার সার্কুলেশন যেটা ৬ হাজারেরও কম, সেটা তিনি ২ লাখ ৯৯ হাজার দেখাতে বাধ্য করেছেন। এখন তো হিসেবও বেরিয়েছে ২৯৬ কোটি টাকা ওনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেন করা হয়েছে। সর্বাধিক প্রচারিত যে দাবি করা হয়, হকারের বেচা-বিক্রি হিসেবে সেটাও ঠিক না।’
রাজধানীর দুটো সংবাদপত্র হকার্স সমিতিতে পত্রিকা বিক্রির পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘হকারদের পত্রিকা বিক্রির হিসেবের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। ঢাকা শহর থেকে ৩০২টি পত্রিকা মিডিয়া লিস্টে আছে, সারাদেশে ৫৯২টির মতো পত্রিকা আছে। আমরা দেখেছি হকারদের তালিকায় ৪৬টি কাগজ তারা লেনদেন করে। বাকি কাগজগুলোর কোনো পেপার (নথি) নেই। কেউ কিনে না ওই পত্রিকাগুলো। তাহলে এটা সরকারের মিডিয়া লিস্টিং এর মধ্যে ঢুকলো কি করে ? এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।’
একই ব্যক্তি একাধিক শ্রেণির সংবাদপত্রের মালিক হতে পারবে না- সাংবাদিকদের এমন মন্তব্যের জবাবে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, ‘এটা কিন্তু অনেক দেশেই নাই। এমনকি আমেরিকাতেও একটা টেলিভিশন কোম্পানির মালিক একটা পত্রিকার মালিক হতে পারেন না। আমাদের এখানে একই হাউসে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার একই হাউসে টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন এবং বাংলা-ইংরেজি সংবাদপত্রের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একই হাউস থেকে একাধিক বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। তাইলে পাঠক কি পাচ্ছে ? এখানে কোনো বৈচিত্র থাকছে না।
বাংলাদেশে ৪৬টি টেলিভিশন চলার মতো বাজার নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপরও কিন্তু ৪৬টি টেলিভিশনকে সরকার অনুমতি দিয়েছে। এটাতো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এই টেলিভিশন কেন্দ্রগুলোর যেহেতু বাজার নেই সেহেতু তারা যথেষ্ঠ আয় করতে পারে না। আবার নিয়োগ দেয় বিনা বেতনে, কার্ডের ব্যবসায় চলে যায়। ফলে একটা দুষ্ট চক্র তৈরি হয়েছে। এগুলো ভেঙে একটা শৃঙ্খলা আনতে হবে।’
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক গীতিআরা নাসরীন, শামসুল হক জাহিদ, আখতার হোসেন খান, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব সিনিয়র সাংবাদিক জাহিদুল করিম কচি, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমানসহ বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন সংবাদপত্রের সম্পাদক, প্রকাশক, জেলা ও জেলার বাইরের বিভিন্ন সংবাদকর্মীরা।