শিরোনাম
হাওরাঞ্চল, (নেত্রকোনা), ৬ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : নেত্রকোনা জেলার হাওর উপজেলা খালিয়াজুরীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধনু নদে প্রভাবশালীদের দখলের কারণে মাছ ধরতে পারছে না প্রকৃত জেলেরা। স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাঁশ, গাছের ডালপালা ও বড় বড় জাল দিয়ে ঘের তৈরি করে নদের জায়গা দখল করে নির্বিচারে মাছ নিধনের উৎসবে মেতেছে।
উন্মুক্ত এ জলাশয়ে মাছ ধরে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে খালিয়াজুরী উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের অন্তত ১২ হাজার জেলে। কিন্তু অবৈধ ঘের তৈরি করা প্রভাবশালীদের বাধার কারণে বর্তমানে প্রকৃত জেলেরা নদে মাছ ধরা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় জীবন জীবিকার তাগিদে জেলেরা অনেকেই পেশা বদল করেছেন।
ধনু নদে স্বাভাবিক নৌযান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে এবং নদ দখল করে স্থাপন করা অবৈধ ঘেরের কারণে যেকোনো সময় বড় ধরনের নৌ দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরী হয়ে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর দিয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে ধনু নদ। খালিয়াজুরী উপজেলায় ধনু নদের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটার ।
এ নৌপথে সারাবছর পানি থাকায় অসংখ্য ছোট বড় নৌকা, ট্রলার, লঞ্চ, বলগেড ও কার্গোসহ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে। কিন্তু অবৈধ দখল, দূষণ, অপরিকল্পিত ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণ, উন্মুক্ত জলাশয় প্রভাবশালীদের কাছে লিজ দিয়ে দেয়া, পাহাড়ি ঢল ও পলি জমে ভরাটের কারণে দিন দিনই ধ্বংসের মুখে পড়ছে ধনু নদ এবং চরম হুমকিতে পড়ছে এখানকার জীববৈচিত্র্য।
সরজমিনে দেখা গেছে, খালিয়াজুরী উপজেলার পাথরা, হারাকান্দি, শালদীঘা, লেপশিয়া, আসদপুর, শিবির, জগন্নাথপুর, রসূলপুর, পাঁচহাট এলাকায় অসংখ্য মাছ ধরার ঘের তৈরি করে রেখেছেন প্রভাবশালীরা। এতে স্বাভাবিক নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। প্রায়ই ঘেরে বাঁশ, গাছের ডালপালা ও জালে আটকে যাচ্ছে নৌকা।
স্থানীয়রা জানান, অসাধু প্রভাবশালী মহল বর্ষার শুরু থেকেই লাখ লাখ টাকায় গাছের ডাল কিনে রাখে। পরে হাওরের পানি কমতে শুরু করলেই ওই সব ডালপালা নদীতে ফেলে বাঁশের খুঁটি পুতে ঘেরাও করে ঘের তৈরি করে । উপজেলা প্রশাসনের যথাযথ তদারকি না থাকায় এভাবে ধনু নদ দখল করে নির্বিচারে মাছ নিধন দিন দিন বেড়েই চলছে।
খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের নয়াপাড়া গ্রামের মৎস্যজীবী সূধীর বর্মণ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রত্যেক বছর খালি লেখ্যাই (লিখে) নেয়। কোনো কামেই অয়না। জালো (জেলে) ব্যাডাইনের কোনো দাম নাই। আমরার কথা লিইখ্যা কিতা অইব! গাং তো ধনী ব্যাডাইনের দহলেই থাকতাছে। আমরা নদীত যাইতামই পারি না। গেলে বাধা ও হুমকি দেয়।'
একই গ্রামের পরিমল বর্মন বলেন, আমরা অহন বাপ-দাদার পেশা ছাইড়া মাইনসের বাড়িতে কামলা (দিনমজুর) দেই আর উজান থ্যাক্কা পাঙ্গাশ মাছ আইন্যা বেছি। উপজেলার পাঁচহাট গ্রামের আপনুজ্জামান আপন বলেন, ধনু নদে অসংখ্য ঘের দিয়ে অবাধে মাছ ধরার ফলে নদের গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। নদের ভাঙন বাড়ছে। ভাঙনের ফলে পাঁচহাট গ্রামটি প্রায় বিলীনের পথে।
এই নৌ পথে চলাচলকারী নৌপরিবহনের মালিক মো. জাকির হোসেন বলেন, এমনিতেই নদটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে আবার প্রভাবশালীরা নদে শত শত মাছ ধরার অবৈধ ঘের তৈরি করে নদকে আরো ছোট করে ফেলছে। এতে করে আমাদের মালবোঝাই নৌকা নিয়ে চলাচল করতে সমস্যা হয়।
পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) এর নেটওয়ার্ক সদস্য সাংবাদিক মো. দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, ধনু নদ প্রভাবশালীদের হাত থেকে দখলমুক্ত করা খুব জরুরি।
নদে কয়েকটি ঘের স্থাপনকারী উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের পাঁচহাট গ্রামের ইউপি সদস্য রফ মিয়া বলেন, ধনু নদে আমার কয়েকটি ঘের ছিল। এখন মাত্র একটা আছে। প্রশাসন নিষেধ করলেও তা কেউ শুনে না।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ আজহারুল আলম বলেন, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে হলে প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই উপজেলা প্রশাসনকে নিয়ে নদকে দখলমুক্ত করতে অভিযান চালানো হবে। খালিয়াজুরী উপজেলার লেপশিয়া বাজার নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক দিলীপ কুমার দাস বলেন, নদী থেকে অবৈধ বাঁশ, কাঁটা সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব হলো বিআইডব্লিউটিএ’র।
এ বিষয়ে খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাসিব-উল- আহসান বলেন, ঘের করে নদ-নদী দখল করে মাছ নিধন করা মৎস্য আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ধনু নদ থেকে দ্রুত ঘের উচ্ছেদ ও জেলেদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াসহ এখানে নির্বিঘ্নে নৌ-চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে।