বাসস
  ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৫১

হারভেস্টার মেশিনসহ ৪০ হাজার কৃষি যন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে দুদকের অভিযান

ছবি: দুদকের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া

ঢাকা, ৮ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’-এর আওতায় হারভেস্টার মেশিনসহ অন্যান্য ৪০ হাজার কৃষি যন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে সারাদেশে একযোগে আজ ৬টি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কমর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম জানান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষিযন্ত্র বিতরণে অনিয়মের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান কার্যালয় থেকে রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে আজ একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট টিম অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প কার্যালয় সরেজমিনে পরিদর্শন করে। পরিদর্শনকালে তারা হারভেস্টার মেশিন বিতরণে অনিয়ম, প্রকৃত কৃষক নির্ধারণে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয়, কারসাজির মাধ্যমে কৃষকদের কাছে হারভেস্টার মেশিনের দাম বাবদ প্রকৃত দামের চেয়ে ৩ গুণ বেশি অর্থ আদায়, প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের গাফিলতি ইত্যাদিসহ নানা অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পায়। অভিযানকালে সংগৃহীত রেকর্ডপত্র পর্যালোচনাপূর্বক এনফোর্সমেন্ট টিম কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

এছাড়া কুষ্টিয়া জেলার ৬ উপজেলায় সরকারের ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের ভর্তুকির কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসের আওতাধীন ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় অনিয়ম/দুর্নীতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়। পর্যালোচনায় দেখা যায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসের আওতায় এই প্রকল্পে মোট ৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন (প্রতিটির মূল্য ৩৮ লাখ টাকা) কৃষকদের মাঝে বিতরণ দেখানো হয়েছে, যেখানে অধিকাংশ গ্রাহকের আবেদন, প্রত্যয়নপত্র ও সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্রে থাকা তথ্যের সাথে বাস্তবের গড়মিল পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অভিযানকালে দেখা যায় প্রদত্ত মোবাইল নম্বরসমূহ ভিন্ন ব্যক্তির । টিম জানতে পারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৮ টি পটোটো ডিগার (প্রতিটির মূল্য দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা) বিতরণ দেখানো হয়েছে। একই পরিবারের তিনজনের নামে এই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে, আবার একজন গ্রাহকের আবেদন ফরমে কৃষি কর্মকর্তার মোবাইল নম্বরও দেওয়া হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত ফর্মে তথ্যের অমিল রয়েছে বলে অভিযানকালে দেখা যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ২৮টি রিপার মেশিন (প্রতিটির মূল্য এক লাখ ৯০ হাজার টাকা) বিতরণ দেখানো হলেও তাৎক্ষনিকভাবে কিছু গ্রাহকদের সাথে ফোনে কথা বলে জানা যায়, তারা রিপার মেশিনের জন্য আবেদন করলেও তাদেরকে কোন মেশিন প্রদান করা হয়নি। অভিযানে প্রাপ্ত সকল তথ্যাবলি সন্নিবেশ করে কমিশন বরাবর বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। 

এদিকে বরগুনা জেলার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প ঘিরে কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। 

অভিযান পরিচালনাকালে এনফোর্সমেন্ট টিম সংশ্লিষ্ট অফিসসমূহ থেকে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। এ সময় সরেজমিনে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনপ্রাপ্ত উপকারভোগীদের সাথে কথা বলা হয় এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন প্রাপ্ত ব্যক্তিরা অধিকাংশই বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত কিংবা চাকরিজীবী। তারা কেউই কৃষি কাজের সাথে সরাসরি জড়িত নন, অধিকাংশেরই কৃষি কার্ড নেই। তারা আরও জানতে পারে, মেশিন বরাদ্দপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই তাদের মেশিন বিক্রি করে দিয়েছেন, যা পুনরায় সংশ্লিষ্ট মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান/কোম্পানি কর্তৃক ক্রয় করা হয়েছে- যা পুরোপুরি বিধিবহির্ভূত। এছাড়াও নিকট আত্মীয়দের বরাদ্দ দেখিয়ে কেউ কেউ একাধিক মেশিনের মালিক হয়েছেন বলে জানা যায়। মেশিনের গায়ে চেসিস নাম্বার এবং ইঞ্জিন নম্বর খোদাই আকারে লেখা থাকার কথা থাকলেও সরেজমিনে দেখা যায়, ওই নম্বর স্টিকার দিয়ে লাগানো। মেশিন বিতরণ এবং তদারকির ক্ষেত্রেও নানা অনিয়মের তথ্য পায় দুদক টিম। 

নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের ময়মনসিংহ সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে অপর একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। টিম প্রথমে সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও জেলা কৃষি অফিস থেকে প্রয়োজনীয় রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করে। পরবর্তীতে সরেজমিনে উপকারভোগীদের তথ্যাবলি যাচাই করা হয়। যাচাইপূর্বক সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নামে ১০টি মেশিন বিতরণের তথ্য পাওয়া যায়, যে পরিবারের একজন কর্মকর্তা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়াও একই মেশিন দুইবার বিতরণ, নিকট আত্মীয়দের নাম দিয়ে একাধিক মেশিন পাওয়া, মেশিন প্রাপ্তির পরপরই বিক্রিসহ নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়। 

এদিকে ঢাকার দোহার উপজেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প ঘিরে কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-২ থেকে দোহার উপজেলা কৃষি অফিসে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। 

অভিযানকালে দুদক টিম উপজেলা কৃষি অফিস সরেজমিন পরিদর্শন করে বর্ণিত ধান কাটার মেশিন তথা কম্বাইন্ড হারভেস্টার প্রকৃত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে কি না সে সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র যাচাই করে। রেকর্ডপত্র বিশ্লেষণে এবং প্রাথমিক যাচাইয়ে টিম বিতরণে অনিয়মের বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। 

এ ছাড়া সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন কৃষকদের মাঝে বিতরণে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সিলেট সমন্বিত জেলা কার্যালয় থেকে একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানকালে উপপরিচালকের দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হয়। রেকর্ডপত্র প্রাথমিক যাচাইয়ে দেখা যায়, একই ব্যক্তি একাধিক কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন পেয়েছেন, আবার একই মোবাইল নম্বর দিয়ে একাধিক ব্যক্তি হারভেস্টার মেশিন নিয়েছেন। এছাড়া এক ব্যক্তির নামে বরাদ্দকৃত হারভেস্টার মেশিন উপজেলা কৃষি অফিসারের যোগসাজশে অন্য ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়েছে-এমন তথ্য পায় দুদক টিম। সার্বিক বিশ্লেষণে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা রয়েছে বলে অভিযানকালে টিমের কাছে পরিলক্ষিত হয়। 

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনাসাপেক্ষে এনফোর্সমেন্ট টিম কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।