বাসস
  ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ২১:৩৪

ব্যবসায়ে বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ

ঢাকা, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): নারী এগিয়ে গেছে সর্বত্র। ব্যবসায়েও বেড়েছে নারীর অংশগ্রহণ। শহর থেকে গ্রাম- প্রায় সবখানেই ছোট-বড়, খুচরা-পাইকারি সব ধরনের ব্যবসায়ে সমানভাবে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন তাদের সেই সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিজের বুদ্ধি ও মেধা খাটিয়ে নারীরা ব্যবসাখাতে যেমন এগিয়ে গেছেন, তেমনই তাদের পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা বেড়েছে। এতে নারীর যেমন ক্ষমতায়ন ঘটেছে, তেমনই উন্নয়ন সূচকেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটা সময় নারীরা শুধু কম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বেছে নিতেন। বিশেষ করে শিক্ষকতা কিংবা অফিসিয়াল কোনো কাজ। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। ঘরে বাইরে সমান তালে সাহস ও মেধা দিয়ে নিজের পথ নিজেরাই তৈরি করেছে মেয়েরা। এতে তারা নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন,তেমনই দেশের অর্থনীতির চাকাকেও সচল করে তুলেছেন। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন করে এগিয়ে যাচ্ছে উত্তরসূরী তরুণীরাও। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে’ শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘অর্থনীতিকে সচল রাখতে অন্যতম প্রভাবক খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা। এ খাতের বার্ষিক মূল্যসংযোজন ৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। দেড় দশক আগেও খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় পুরুষদেরই একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল।। নারীদের অংশগ্রহণ ছিল দেড় শতাংশেরও নিচে। তবে এ পরিসংখ্যান পাল্টেছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় এখন নারীদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। এক দশকের ব্যবধানে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। তাদের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মূল্যসংযোজন হচ্ছে। এর মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বিতা ও নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে।’ 

জানা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির হিসাবের ক্ষেত্রে ২১টি প্রধান খাতকে বিবেচনা করা হয়। এসব খাতের মধ্যে অন্যতম পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্য। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন। আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ২ লাখ ৩ হাজার ১৮৯। তবে পুরুষের তুলনায় এখনো কম হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা এক দশকে ১২৬ শতাংশ বেড়েছে।

২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। একইভাবে গত ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে। এ সংখ্যা ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭। এভাবে গত দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বাড়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ব্যবসায়ে নারীর অংশগ্রহণ বা নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৮২৯ শতাংশ। 

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ব্যবসায়ে নারীদের আগ্রহ বেশি। কৃষি ও মৎস্য খাত, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায়ে নারী ব্যবসা করছে বেশি। গার্মেন্ট ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। 

অনলাইন ব্যবসায়েও নারীর অংশ গ্রহণ বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে অনলাইন ব্যবসায়ে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মনে করেন নারী উদ্যোক্তা অন্তরারূপা তালুকদার। ফেসবুকে ‘বসনাঙ্গন’ নামে তার একটি পেজ রয়েছে; যেখানে জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। এই ব্যবসায় তার মাসিক বিক্রিবাট্টা দেড় লাখের বেশি বলে জানান এই উদ্যোক্তা। 

রূপা বলেন,সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যকেন্দ্রিক উদ্যোক্তাদের এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এখন সারা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয়। 

২০১৭ সাল থেকেই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ লাখ। দেশে নারী উদ্যোক্তাদের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে নারীদের এগিয়ে নেওয়ায়ই এ সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। 

ই-কমার্সভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের বর্তমান সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে জানতে চাইলে উই-এর সভাপতি নাসিমা আক্তার বলেন, গত সাত বছরে নারীদের ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিশেষ করে করোনার সময়ে নারীরা ব্যবসায়ে এসেছেন বেশি। শিক্ষিত নারীর সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষিত নারী ব্যবসায়ে বেশি আসছেন। শিক্ষিত নারীরা অনলাইন ব্যবসায়ে নিজে আগ্রহী হচ্ছেন। একজন নারীকে দেখে অন্যরাও আসছেন। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৈরি পোশাকশিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে নারীর অবদান দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে। গত দুই দশকে ব্যবসায়ে নারীর অংশগ্রহণ তার একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ব্যবসায়ে লাভ হওয়ায় পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্য তার আগের কাজ ছেড়ে ওই নারীর ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছেন। এতে নারীর ব্যবসা পরিচালনায়ও সুবিধা হয়েছে। 

তবে ব্যবসায়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও প্রতিবন্ধকতা দূর হয়নি। ব্যবসায়ে নারী-পুরুষ বৈষম্য ও নারীর প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করতে গবেষণা পরিচালনা করেছে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)। দুই সংস্থার  পরিচালিত ‘চ্যালেঞ্জেস অব ট্রেডিং অ্যাক্রস বর্ডারস ফেসিং দ্য উইমেন ট্রেডারস অব বাংলাদেশ: রিসেন্ট ফাইন্ডিংস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,‘আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত বিশেষ করে ঋণপত্র (এলসি), নগদ সুবিধা ও জিএসপি সনদ পেতে ও নবায়ন করতে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তাদের বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয়। 

নারীদের জন্য ট্রেড ও বন্ড লাইসেন্স,এলসি খোলা ও নগদ সুবিধা পাওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করার ক্ষেত্রেও জোর দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, নারীদের সক্ষমতা তৈরি,প্রচ্ছন্ন ব্যয় (হিডেন চার্জ) বন্ধ করা,লিড টাইম কমানো,ব্যাংকিং অর্থায়ন পেতে নারী উদ্যোক্তাদের গ্যারান্টারের সংখ্যা কমানো,নারীদের জন্য সক্রিয় হেল্প ডেস্ক চালু করতে হবে। সনদায়ন ও অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহযোগিতামূলক আচরণ ও এইচএস কোডসংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে হবে।

অনলাইনে ব্যবসার পরিধি বেড়েছে। এ ব্যবসার প্রসারে গঠিত হয়েছে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন। ই-ক্যাবের সাবেক সহ-সভাপতি ফুডপান্ডার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দা আম্বারিন রেজা বলেন, অনলাইন ব্যবসার বিপ্লব ঘটে গেছে। ই-কমার্স কার্যক্রম ইন্টারনেটের ওপর পুরোটাই নির্ভরশীল। শহর বা গ্রাম সব জায়গায় দ্রুতগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা জরুরি। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়ার বাধা দূর করলে গ্রাম ও শহরে অনেক উদ্যোক্তা তৈরি হবে। পাশাপাশি সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট সংযোগপ্রাপ্তি ই-কমার্স ব্যবসাকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

তিনি বলেন, ই-কমার্স উদ্যোক্তারা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে ই-কমার্স উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিতে পারবেন। গত মাসে ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটের ঘটনায় ই-কমার্স উদ্যোক্তারা সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ই-কমার্স ব্যবসা একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছিল। 

এসব বিবেচনায় তাদের স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা দেওয়া এবং ক্ষয়ক্ষতির বিবেচনায় ব্যাংকঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো জরুরি বলেও মনে করেন আম্বারিন রেজা। তার পরামর্শ,অনলাইন ব্যবসাকে এগিয়ে নিতে ভ্যাট ও ট্যাক্সসংক্রান্ত বিষয়গুলোয় ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্ট নীতিমালা সহজ ও বোধগম্য করতে হবে। উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্টের পর কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় ই-ক্যাবে ১১ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল সেলের উপসচিব মুহাম্মদ সাঈদ আলীকে ই-ক্যাবের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ১২০ দিনের মধ্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।