শিরোনাম
ঢাকা, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা শুধু ঘরকন্না নিয়েই ব্যস্ত নয়। সংসারের কঠিন কর্মকাণ্ডের মধ্যেই দেশজুড়ে নিজেদের মতো করে গড়ে তুলছেন নিজেদের জগত। কেউ কাজ করছেন খাবার নিয়ে, কেউ বা ফ্যাশন/কাপড়। অনেকেই আছেন গহনা নিয়ে। আবার হাল আমলের অনেকেই যুক্ত হয়েছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এমনই একজন তাসলিমা মিজি।
তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা একটু অন্যরকম। তিনি প্রচলিত পণ্য ও বিষয়ের বাইরে বেছে নিয়েছিলেন ভীষণ চ্যালেঞ্জিং একটি ক্ষেত্র। সেটি হলো চামড়াজাত পণ্য ও হস্তশিল্প। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন তার ব্যবসার জগত।
সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
জানা যায়, তাসলিমা মিজি একটি ফেসবুক পেজ খুলে যাত্রা শুরু করেছিলেন। পেজের নাম দিয়েছিলেন ‘গুটিপা’। তার সেই ছোট্ট ‘গুটিপা’ আজ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেছে দেশের চামড়াশিল্প ব্যবসায়। ২০১৬ সালে তার ‘লেদারিনা’ কোম্পানির যাত্রা শুরু। চামড়াশিল্প একটি অপ্রচলিত খাত। এ খাতে নারী ব্যবসায়ীদের পদচারণা নিতান্তই নগণ্য।
এর কারণ হিসেবে নারী উদ্যোক্তা মিজি বলেন, ট্যানারি থেকে চামড়া সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করার পুরো বিষয়টি এত বেশি ঝক্কির যে, নারীর জন্য সেই খাতে কাজ করাটা বেশ কষ্টকর। আর আমি বিয়ষটি জেনে-বুঝেই সবার মতো এক পথে হাঁটতে চাইনি। ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা নিয়েই এই খাতে এসেছি।
তিনি বলেন, একজন উদ্যোক্তা হতে গেলে সাহস ও ধৈর্য এই দুটো বিষয় থাকা সবচেয়ে জরুরি। অনেক সময় নানা সঙ্কটে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। তবুও নিজের ব্র্যান্ডটাকে দাঁড় করাতে চেয়েছি। সেজন্য লেগে ছিলাম, এখনও আছি।
আর এভাবেই উদ্যোক্তা তাসলিমা মিজি আজ অন্যদের কাছে এক সাহসের নাম, এক অনুপ্রেরণার নাম। রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কের সপ্তক স্কয়ারে রয়েছে ‘গুটিপা’র সাজানো শোরুম। সেখানে চোখ ধাঁধানো ডিজাইনের সব ব্যাগ আর জুতা চামড়াশিল্পে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার জানান দেয়। যেখানে গ্রাহকদের নিত্যনতুন পণ্যসংগ্রহে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
শুধু দেশেই নয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাসলিমা মিজির পণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও যুক্তরাষ্ট্রে। ভবিষ্যতে নিজের ব্র্যান্ডটির সর্বত্র প্রসার দেখতে চান তিনি।
শুরুর দিনগুলোর কথা জানতে চাইলে তসলিমা মিজি বলেন, খুব অল্প পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। পুঁজি বলতে ছিলো শুধুই সাহস আর লেগে থাকার ধৈর্য। যেহেতু পুঁজি নেই। তাই লোকবলের অভাবও সেই প্রথম থেকেই।
তাই ফেসবুক পেজে নিজের ডিজাইনের পণ্য নিজেই পোস্ট করতে থাকেন। পণ্যের মান ও বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের কারণে খুব কম সময়ে ‘গুটিপা’ ক্রেতার কাছে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করে নেয়। সমাজের বাধা, পারিবারিক প্রতিকূলতা অথবা সমাজের চোখ রাঙানি কিছুই দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। তিনি এগিয়ে গেছেন তাঁর স্বপ্নের পথে।
তিনি বলেন, সবকিছু পেছনে ফেলে আমি আমার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছি। এখন আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি।
তাসলিমা মিজি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর করেন। পরে কর্মজীবন শুরু হয় সাংবাদিকতা দিয়ে। সাংবাদিকতা তাঁর ভালো লাগার পেশা হলেও একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইতেন। সেই চেষ্টা থেকেই আজকের এ পর্যায়ে এসেছেন তিনি।
মিজি জানান, করোনার সময়ে স্বাস্থ্যসেবার অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস বিশেষ করে মাস্ক, পিপিই ও হেডকভার তৈরির মাধ্যমে ব্যবসা টিকিয়ে রাখেন।
নিজের কাজের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা চামড়াজাত পণ্যের গুণগত মান বজায় রাখার পাশাপাশি নিত্যনতুন ডিজাইন তৈরি করেছি। আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন কী কী চামড়া পণ্য আসছে, সেগুলোয় কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এসব নিয়ে গবেষণার জন্য গুটিপার রয়েছে নিজস্ব টিম। এ টিমের সবাই প্রশিক্ষিত।
তাসলিমা মিজি দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে নানা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাভারে তাঁর কারখানার ৫০ জন কর্মীর মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী। নারীর ক্ষমতায়নেও কাজ করে চলেছেন তিনি।
এদিকে তাসলিমা মিজি উদ্যোক্তা হলেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন পরিবেশবাদী। তাই তার ব্যবসাতেও পরিবেশ সচেতনতার বিষয়টি বেশ ভালোভাবে অনুসরণ করেই কাজ করছেন। তিনি মনে করেন চামড়াশিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি আমাদের নদী ও পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। ‘তবে এটি আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আমার ক্ষুদ্র জায়গা থেকে নিজের কাজটা করে চলেছি। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। জনগণকেও সচেতন হতে হবে,’ বলেন তাসলিমা মিজি।
নানা বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক ট্যানারি আছে, যেগুলো পরিবেশবান্ধব নয়। অনেক ট্যানারিতেই বর্জ্য পরিশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিশোধনাগার বা ইটিপি নেই। ইটিপি থাকলেও তা ব্যবহার করা হচ্ছে না। হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো আগে বুড়িগঙ্গা দূষণ করত, এখন সাভারের ট্যানারি থেকে আসা পানিতে দূষিত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা। ফলে নদীদূষণের যে চক্র শুরু হয়েছিল এ ট্যানারি শিল্প থেকে সেটি এখনও চলমান।
‘বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিদেশি ক্রেতার কাছে সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে এ পরিবেশ দূষণের বিষয়টি; যা আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়াশিল্পজাত পণ্যের ক্ষেত্রে
বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে। ডিজাইন, দাম, মান সবকিছুতে বাংলাদেশি পণ্য এগিয়ে থাকলেও, শুধু পরিবেশগত কারণে বিদেশি ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। গার্মেন্টসের মতোই বাংলাদেশের আরেক সম্ভাবনাময় খাত চামড়া খাত।’
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তাসলিমা মিজি বলেন, ‘যখন আপনি স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটবেন, তখন আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি আপনি নিজে, আপনি নিজে যখন আপনার হাতটা ধরবেন তখন যত বাধা আসুক, আপনি সেই বাধা পার করতে পারবেন।’