শিরোনাম
॥ মো. মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ১৬ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): অনলাইন উদ্যোক্তা আরিফুজ্জামান মুন, শৈশব থেকে দারিদ্র্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করেই এখন স্বাবলম্বী। তিনি স্থানীয় যুবকদের কাছে আইকনে পরিণত হয়েছেন। যুবকরা মুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বনির্ভরতাও অর্জন করছেন।
রংপুরের সদর উপজেলার সদ্যপুস্করিণী কাগজিপাড়া গ্রামের ৩৭ বছর বয়সী যুবক মুন বাসসের সঙ্গে আলাপকালে একের পর এক নিজের সাফল্য অর্জনের গল্প বর্ণনা করেন।
মুন তার ছাত্রজীবনে ২০০৮ সাল থেকে কম্পিউটার শেখার প্রতি আগ্রহ নিয়ে নামমাত্র মূল্যে জনসাধারণের দোরগোড়ায় ডজন-ডজন অনলাইন এবং অফলাইন পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া শুরু করে করেন। বর্তমানে তার চারটি ব্যবসায়িক আউটলেট পরিচালনার সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে লাখ টাকা আয় করেন।
মুন বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমাকে জীবিকার পেছনে ছুটতে হয়েছে। আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে আমি বড়। আমার কোনো বোন নেই। অভাবগ্রস্ত বাবার আমাকে সাহায্য করার ক্ষমতা ছিল না, আমি চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে যাই। আমি ২০০৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। আমার দিনগুলো কষ্টের মধ্যে কেটে যাচ্ছিল, আমি কখনও আত্মবিশ্বাস হারাইনি এবং আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ২০০৮ সালে যখন রংপুর শহরেও কম্পিউটারের সংখ্যা সীমিত ছিল, তখন আমি কম্পিউটার শেখা শুরু করি।
কম্পিউটার সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য, মুন স্বেচ্ছায় তার গ্রামের কাছে সদ্যপুস্করিণী ইউনিয়নের পালিচড়া বাজারে একটি ডিজিটাল ফটো স্টুডিওতে যোগদান করেন। তার অসাধারণ পারফরম্যান্স বিবেচনা করে, স্টুডিওর মালিক শিগগিরই মুনকে নিয়োগ দেন। তাকে মাসিক বেতন দেওয়া শুরু করেন এবং তিনি তার পরিবারকে সহায়তা করার পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যান।
মুন বলেন, আমি একদিন জানতে পারলাম দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) একজন পুরুষ ও একজন মহিলা উদ্যোক্তা নিয়োগ করা হবে।
এরপর তিনি জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট আয়োজিত কম্পিউটার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি), ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটালাইজড কার্যক্রমের উপর প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন।
মুন বলেন, ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর আমি সদ্যপুস্করিণী ইউডিসিতে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে যোগদান করি। এরপর থেকে আমি স্বনির্ভরতা অর্জন এবং আমার বাবা-মায়ের জন্য সুখ বয়ে আনার এবং স্থানীয় যুবকদের সাফল্য অর্জনের জন্য কম্পিউটার শিখতে উৎসাহিত করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করি।
মুন তার সহ-উদ্যোক্তা তাজনুর বেগমের সঙ্গে শুরুতে একটি কম্পিউটার, একটি কালো এবং সাদা প্রিন্টার এবং একটি মডেম দিয়ে সাধারণ মানুষকে অনলাইন এবং অফলাইন উভয় পরিষেবা প্রদান শুরু করেন।
এ সময়ের মধ্যে, মুন ২০১২ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে রসায়নে অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেন।
মুন বলেন, আমার কাছে এখন ১২টি নিজস্ব ল্যাপটপ কম্পিউটারসহ লেজার এবং কালার প্রিন্টার, ডিজিটাল ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা, অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ, প্রজেক্টর, পাওয়ার জেনারেটর, আইপিএস, সোলার প্যানেল, স্ক্যানার, পজ মেশিন, সাউন্ড সিস্টেম ও অন্যান্য সরঞ্জাম রয়েছে। এতে মুন এখন সাধারণ মানুষকে ১৬০ ধরনের অনলাইন এবং অফলাইন পরিষেবা প্রদানের করতে পারছেন।
এলাকার তথ্য নেতা হিসেবে পরিচিত মুন বলেন, আমি এ পর্যন্ত আমার ইউডিসিতে প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন শিক্ষিত তরুণ ও তরুণীর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি। তারা এখন সবাই আয়বর্ধক কাজে নিযুক্ত আছেন এবং আরও অনেকে এখনো আমার ইউডিসিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
এই ইউডিসিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করার পর প্রায় ২৫ জন যুবক তাদের নিজস্ব ব্যবসায়িক কেন্দ্র চালু করেছেন এবং সফলভাবে সেগুলো পরিচালনা করছেন। বাকিদের বেশিরভাগই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাকরিতে প্রবেশ করেছেন।
তিনি বলেন, উদাহরণস্বরূপ, কাঁটাবাড়ি গ্রামের নিহাত নয়ন এখন ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানির কম্পিউটার বিভাগে কাজ করেন, মিল বাজার গ্রামের মুরাদ মিয়া ঢাকায় একটি কম্পিউটার বায়িং হাউসে কাজ করেন ইত্যাদি।
ধারাবাহিক সাফল্য অর্জনে কয়েক বছর ধরে মুন সদ্যপুস্করিণী ইউডিসি সংলগ্ন পালিচড়া বাজারে তার নিজস্ব তিনটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র চালু করেছেন। এগুলো হলো- ডিজিটাল সাব-সেন্টার-১, ডিজিটাল সাব-সেন্টার-২ এবং সাইফ এন্টারপ্রাইজ।
মুন বলেন, আমার ইউডিসি এবং আমার ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক আউটলেটে পাঁচজন কর্মচারী কাজ করছেন এবং আমি এখন প্রতি মাসে তাদের ৪৫ হাজার টাকা বেতন দিই। এছাড়াও তারা ইউডিসিতে বা নিজ উদ্যোগে অতিরিক্ত কাজ করে আরো আয় করেন।
মুন তার ইউডিসি থেকে দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে কাগজোজিপাড়ায় ১৪ শতাংশ জমি কিনে ২০১৮ সালে একটি পাকা ভবন তৈরি করেছেন। তার বাবা-মা এখন সেখানে থাকেন।
এছাড়াও একজন মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে মুন সারাদেশে জেলা, উপজেলা প্রশাসন এবং সরকারি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কম্পিউটার, আইসিটি, আউটসোর্সিং এবং অন্যান্য বিভিন্ন অনলাইন পরিষেবার ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন।
২০১৫ সাল থেকে মুন তার নিজস্ব অনলাইন ব্যবসায়িক আউটলেটে বিক্যাশ, নগদ, রকেট, উপায় মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা, এনআরবিসি ব্যাংক ও মধুমতি ব্যাংক লিমিটেডের এজেন্ট ব্যাংকিং পরিচালনা করেন। এসবে তার গড় মাসিক লেনদেন এখন প্রায় দুই কোটি টাকা।
মুন বলেন, অসংখ্য মানুষ আমার ইউডিসিতে হজ নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং ভিসা আবেদনসহ দেশে পাওয়া যায় এমন প্রায় ১৬০টি অনলাইন পরিষেবার সবগুলো সহজেই পাচ্ছেন।
সদ্যপুস্করিণী ইউনিয়নের কেশবপুর গ্রামের মুরাদ মিয়া বাসস’কে জানান, তিনি মুনের ইউডিসি’র অনলাইন পরিষেবা থেকে তার হারিয়ে যাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি সহজেই পেয়েছেন।
একই ইউনিয়নের কেশবপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের আকুল মিয়া বলেন যে তিনি সদ্যপুস্করিণী ইউডিসি থেকে জমি ‘পরচা’র জন্য আবেদন করেছিলেন এবং মাত্র কয়েকদিন পরেই তা পেয়েছেন।
ব্যাংক চেক বই হারানোর পর নিকটবর্তী নয়াপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন রংপুর সদর কোতোয়ালি থানায় এই বিষয়ে আজ বুধবার একটি সাধারণ ডায়েরি করার জন্য ইউডিসিতে অনলাইন পরিষেবা ব্যবহার করে আবেদন জমা দেওয়ার পরে আনন্দ প্রকাশ করেন।
সদ্যপুস্করিণী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সোহেল রানা ইউডিসি উদ্যোক্তা মুনের স্বনির্ভরতা অর্জন, মানুষকে বিভিন্ন প্রকারের সেবা প্রধান এবং এলাকার যুবকদের মধ্যে কম্পিউটার জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তার কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
তিনি বলেন, এই এলাকার উদ্যোক্তা এবং যুবকদের মধ্যে মুন একজন আইকনে পরিণত হয়েছেন। আরও অনেক যুবক মুনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বনির্ভরতা অর্জন করছেন।