শিরোনাম
মনসুর আহম্মেদ,
রাঙ্গামাটি, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : পাহাড়ের প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীদের কাছ ন্যায্যমূল্যে কাঁচামাল হিসেবে কাঁঠাল ও কলা কিনে সেগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে কারখানায় চিপস তৈরি করে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। রাঙ্গামাটির তিন উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা পাহাড়ের কাঁঠাল ও কলা দিয়ে চিপস তৈরী করে জেলায় সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
পাহাড়ের এ তিন উদ্যোক্তা গত বছরের মে মাসে ‘হিলস বাজার’ নামের কারখানা চালু করার পর বর্তমানে প্রাথমিকভাবে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে তাদের উৎপাদিত এসব চিপস। এ কাজে সহযোগিতা করছে ‘বৈচিত্র ডটকম’ নামের পাহাড়ের একটি ই-কমার্স ওয়েবসাইট।
শহরের আসাম বস্তি এলাকায় সফল এ তিনজন উদ্যোক্তার কারখানায় গেলে তারা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) জানান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২০২৪ সালের মে মাসে রাঙ্গামাটি জেলা শহরের আসাম বস্তি এলাকায় ছোট পরিসরে সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা তিনজন মিলে একটি চিপস তৈরীর কারখানাটি গড়ে তুলেন। কারখানাটির কার্যক্রম শুরু করতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) কারিগরি সহয়তা ও ডাচ বাংলা ব্যাংক পিএলসি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে। শুরুটা কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরীর মাধ্যমে কারখানাটি সচল করলেও ভবিষ্যতে অন্যান্য ফলের চিপস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
উদ্যোক্তারা বাসসকে আরো জানান, ২০২২ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ থেকে ‘স্বল্পমূল্যের ভ্যাকুয়াম ফ্রাইং মেশিনের মাধ্যমে আলু, কলা, আম ও কাঁঠালের গুণগত মান বজায় রেখে উৎকৃষ্টমানের চিপস তৈরীর প্রযুক্তি ও কলাকৌশল’ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নিয়ে রাঙ্গামাটির তিন উদ্যোক্তা সুবিমল চাকমা, প্রমথ চাকমা ও শান্তু চাকমা ছোট পরিসরে প্রায় ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে কারখানা করেন। সেখানে ভ্যাকুয়াম মেশিনের সাহায্যে কলা ও কাঁঠালের চিপস উৎপাদন করছেন। প্রাথমিকভাবে স্থানীয় দোকানপাট, বাজার ও বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে চিপস সরবরাহ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান, ফোরামের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিপণন করছেন। ২৫ গ্রাম ওজনের প্রতিটি চিপসের বাজারে ৩০ টাকা খুচরা মূল্য বিক্রি করছেন বলে জানান তারা।
উদ্যোক্তাদের কারখানায় সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, তিন উদ্যোক্তার একজন প্রমথ চাকমাসহ কয়েকজন সহযোগী ভ্যাকুয়াম মেশিনের মাধ্যমে কাঁঠাল ও কলা প্রক্রিয়াজাত করে চিপস তৈরী করছেন। প্রথমে কাঁচামাল হিসেবে কলা ও কাঁঠালকে তেলে মেশিনের মাধ্যমে তেলে ভাজার পর সেগুলো আবার মেশিনের মাধ্যমে শুকিয়ে তেল শুকিয়ে নেয়া হচ্ছে। এরপর চিপসগুলোতে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মসলাসহ অন্যান্য উপকরণ মিশিয়ে প্যাকেটিং করে বায়ু ভর্তি করে বাজারের সরবরাহের উপযোগী করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সাধন চাকমা বাসসকে বলেন, বেশ কয়েকমাস যাবৎ এখানে তিনজন তরুণ উদ্যোক্তা মিলে কাঁঠাল ও কলার চিপস তৈরীর কাজ করছেন। এ চিপসগুলো খেতে এলাকায় অনেকেই কারখানায় আসেন। আমি নিজেই এসে তাদের চিপসগুলো খেয়ে দেখলাম, অনেক সুস্বাদু। কাঁঠাল, কলা যেহেতু আমাদের পাহাড়ি ফল সেক্ষেত্রে স্বাদটাও অনেক ভালো। সরকারী সহায়তার মাধ্যমে এটার পরিসর বাড়ানো গেলে সারাদেশে পাহাড় থেকেই সুস্বাদু এ চিপস সরবরাহ সম্ভব বলে জানান সাধন চাকমা।
বৈচিত্র ডটকম ই-কমার্স সাইটের প্রতিষ্ঠাতা পল্লব চাকমা বাসসকে জানান, আমরা রাঙ্গামাটির সফল তিনজন তরুণ উদ্যোক্তার চিপস বিতরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের উৎপাদিত চিপসগুলো সারাদেশে বিতরণ, বিপণন ও প্রচার করছি অনলাইনের মাধ্যমে। তাদের চিপসগুলো নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি।
স্থানীয় আরেক ই কমার্স তরুণ উদ্যোক্ত সাজিদ বিন মিকি বাসসকে বলেন, পাহাড়ে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল ও পণ্য অনলাইনে ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমে আমরা দেশজুড়ে সরবরাহ করে থাকি। পাহাড়ে উৎপাদিত কাঁঠাল ও কলার চিপসের চাহিদা বাড়ছে।
হিলস বাজার কারাখানার উদ্যোক্তাদের সহযোগী দীপ্ত দে বাসসকে বলেন, রাঙ্গামাটি জেলা শহরের বিভিন্ন মেলা, অনুষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী আমরা চিপস তৈরী করে থাকি। এছাড়া প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০ প্যাকেটের গ্রাহকদের মাঝে বাজারজাতকরণের লক্ষ্যে উৎপাদন করা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।
উদ্যোক্তারা বাসসকে আরো জানান, স্বল্প পরিসরে আমরা এটি শুরু করলেও ধীরে ধীরে সাড়া পাচ্ছি। আপাতত এসব পণ্য এখানকার স্থানীয় বাজার, মেলা ও পর্যটন জায়গায়গুলোতে সরবরাহ করছি। সরকারী সহায়তা পেলে পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের পরিসর বৃদ্ধি পেলে জেলার বাহিরেও বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করা সম্ভব বলে জানান তারা।
এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বাংলাদেশ সংস্থাকে (বাসস) জানান, রাঙ্গামাটিতে অনেক তরুণ উদ্যোক্তা রয়েছে,যারা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করছেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানে সবধরনের সহায়তা করা হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।
রাঙ্গামাটি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোঃ আব্দুল ওয়াদুদ বাসসকে জানান, এখানে যেসব তরুণ উদ্যোক্তা কাজ করছেন তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে চেম্বার অব কমার্সের পক্ষ থেকে ব্যাংক লোন পাওয়ার সহায়তাসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকি।
দেশে উৎপাদিত মৌসুমী ফলের প্রায় এক দশমাংশ উৎপাদন হয় তিন পার্বত্য জেলা-রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে। বিশেষত পাহাড়ের গ্রীষ্মকালীন ফল আম, কাঁঠাল, আনারস ও বারোমাসি কলার কদর বেশি। দেশজুড়ে চাহিদা থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ন্যায্য বাজারমূল্যে অভাব ও ফল বাজারজাতকরণে প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রায় প্রতি মৌসুমেও নষ্ট হচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত ফলের একটি অংশ।
পাহাড়ের ফল পচনরোধ ও নষ্ট করে না সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব মৌসুমী ফল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে বছরজুড়ে অর্থনৈতিক চাকা সচলের পাশাপাশি এসব ফল দিয়ে চিপস, জুস, জেলিসহ নানাধরনের পণ্য উৎপাদন সম্ভব বলে মনে করছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা।