শিরোনাম
শাহজাহান নবীন
ঝিনাইদহ, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ডিজিটাল মার্কেংটিংয়ে সফল তরুণ উদ্যোক্তা আশিকুর রহমান জীবন। বয়স ২৪ বছর। ১০ বছর বয়সে বাবা মারা যাওয়ায় মাকে নিয়েই ছিল তার সংসার। স্কুলজীবন থেকেই টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছেন। চালিয়েছেন সংসার।
ছোট বেলা থেকেই জীবনের ভাবনায় ছিল সাবলম্বী হওয়ার এক অদম্য বাসনা। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কিভাবে আয় করা যায় সেটা নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন দেখতেন তিনি। দেশের হাজারো তরুণের মতো উদ্ভট কন্টেন্ট নিয়ে কাজ না করে, কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করা যায় সেটাই ছিল জীবনের ভাবনায়।
জীবনের প্রথম কাজ যেভাবে শুরু :
করোনাকালীন ২০২১ সালে অসম্ভব চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজে নেমে পড়েন ঝিনাইদহ সদর পৌরসভার কাঞ্চননগর এলাকার আশিকুর রহমান জীবন। একটি মাত্র মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরী করতেন। কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা অন্য কোনো আধুনিক ডিভাইস তার ছিল না। মোবাইল ফোন দিয়েই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ শুরু করেন। প্রথম দিকে কাজ পেতে তাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু অদম্য আশিকুর রহমান জীবন থেমে যাননি।
আশিকুর রহমান জীবন বাসস-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, ২০২১ সালে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে তিনি অল্প কয়েকদিনের একটি কোর্স করেন। ডিজিটাল মার্কেটিং ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে উপার্জন করার কৌশল জানতে তিনি বিদেশী এক তরুণের সঙ্গে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ করেন। তার কাছেই আশিকুর রহমান জীবনের হাতেখড়ি।
আশিকুর রহমান জীবনের প্রথম উপার্জন :
২০২৩ সালের কথা। করোনার ভয়াবহতা থেকে দেশ তখন কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পথে। ফেসবুকের একটি নিজস্ব পেইজ থেকে তিনি প্রথম ৬০ হাজার টাকা আয় করেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রথম রেমিট্যান্স দেশে আনেন জীবন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আশিকুর রহমান জীবন বলেন, আমার মা আমাকে ও আমার একমাত্র বোনকে মানুষ করার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। ছোট বেলায় বাবা মারা গেছেন। আমাদের অনেক কষ্টের সংসার ছিল। কিন্তু মা আমাকে আমার পরিশ্রম দেখে বলতেন, ‘তুই একদিন অনেক বড় হবি বাবা’।
জীবন বলেন, আজ মা নেই। কিন্তু আমি আজ মায়ের দোয়া নিয়েই সফল হয়েছি। আমার মা আমার সফলতার দিনগুলো দেখে যেতে পারলে আমি তৃপ্তি পেতাম। দুই বছর আগে মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমি তার চিকিৎসাও করাতে পারিনি।
নিজের সফলতার গল্প বলতে বলতে আশিকুর রহমান জীবন জানান, এরই মধ্যে তিনি ঝিনাইদহ জেলা শহরে ডিজিটাল মার্কেটিং, ভিডিও কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, গ্রাফিক্স ডিজাইনসহ বেশ কিছু বিষয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন ‘ইনোভেটিভ আইসিটি ট্রেনিং সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তরুণ বেকার যুব সমাজকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে তার এ প্রয়াস।
আশিকুর রহমান জীবন বলেন, আমি টাকার অভাবে মায়ের চিকিৎসা করাতে পারিনি। আমি চাই, কোনো তরুণ-যুবক যেন বেকার না থাকে। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজের মতো করে কিছু করা উচিত। কোনো একটি বিষয়ে যদি কেউ নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তার উপার্জনের অভাব হবে না। ভার্চুয়াল জগতে প্রচুর কাজ রয়েছে। কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাবে সেই কাজগুলো আমরা করতে পারিনা।
তিনি জানান, তার কাছে এখন নিয়মিত ১৫ জন তরুণ-তরুণী ফ্রিলান্সিং, কন্টেন্ট ক্রিয়েশন, আউটসোর্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ১৫টি কম্পিউটার দিয়ে গড়ে তুলেছেন ল্যাব।
আশিকুর রহমান জীবন বলেন, ছাত্রজীবন থেকেই উদ্ভাবনী কাজকে পছন্দ করতাম। নিজের মতো করে কিছু করার স্বপ্ন ছিল। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে আমি এ সুযোগটিই নিয়েছি। গঠনমূলক কন্টেন্ট বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাজ করেছি। মানুষ সাড়া দিয়েছে। মানুষ আমার কাজে সহযোগিতা না করলে আমি এ জায়গায় আসতে পারতাম না।
সাবলম্বী হওয়ার জন্য ইচ্ছেশক্তি ও পরিশ্রমের বিকল্প নেই উল্লেখ করে জীবন আরও বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম অনেক মেধাবী। তাদের চিন্তা-ভাবনাও দারুণ। কিন্তু সময় ও মেধার সঠিক ব্যবহার করতে না পারলে বেকারত্ব গ্রাস করবে। তরুণদের উচিত সময়, শ্রম ও মেধার যথাযথ ব্যবহার করা।
তিনি বলেন, আমি যখন কাজ শুরু করি। অনেকেই আমাকে অবহেলা করত। নানা রকম কটুকথা বলত। আমি কোনো কথায় নিজেকে গুটিয়ে নিইনি। আমি মনে করি, ভালো কাজ করলে কেউ না কেউ পাশে দাঁড়াবেই। মানুষ আমার কাজকে গ্রহণ করেছে। আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিয়মিত আয় করতে পারছি। দেশের অর্থনীতিতে সীমিত পরিমাণ হলেও, কিছুটা অবদান তো আমার থাকছে।
আগামীর বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান বাসস-এর জিজ্ঞাসায় আশিকুর রহমান জীবন বলেন, আমি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। শোষণমুক্ত, ভয়হীন ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ চাই। দেশের জন্য মানুষের জন্য সকলের একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেখতে চাই। অন্যায়, অনিয়ম ও পেশীশক্তির বিড়ম্বনা এ প্রজন্ম পছন্দ করে না। এমন একটি দেশ গড়ে উঠুক, যেখানে দেশের অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সিটিজেনদের পরামর্শে তরুণ-যুব প্রজন্ম দেশের নেতৃত্ব দেবে।