শিরোনাম
॥ কালাম আজাদ ॥
বগুড়া, ২০ জানুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : শখের মোবাইল বিক্রির পাঁচ হাজার টাকায় আচারের ব্যবসা শুরু করে এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন নারী উদ্যোক্তা আফসানা নীরা। বৈশ্বিক মহামারী করোনার সময়ে চারিদিকে যখন মৃত্যু আতংকে সন্ত্রস্ত্র মানুষ তখন চাকরি চলে যায় আফসানার স্বামী সিহাবুর রহমানের। দিশেহারা হয়ে পড়েন তারা।
দুজনে মিলে সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনভাবে বিকল্প কিছু করার। পুঁজি নেই। তাই বলে তো পথচলা থেমে থাকতে পারে না। আফসানার শখের মোবাইল ফোনটি মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়েই শুরু করেন মাংসের আচারের ব্যবসা। দুঃসময়ের আগল ভেঙ্গে সেই আফসানাই এখন বগুড়ার সফল উদ্যোক্তা।
নারী উদ্যোক্তা আফসানা নীরার (৩১) গল্পটা পাঁচ হাজার টাকা থেকে এখন লাখ টাকায় পরিণত হয়েছে। বগুড়ায় গরুর মাংসের আচার তৈরি করে এখন তিনি বিশ্ব দরবারে হাজির হয়েছেন। বদলে গেছে জীবনের গতিপথ। নিজেকে চিনিয়েছেন ভিন্ন রূপে। স্বল্প পুঁজির ব্যবসা থেকে মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে এখন তিনি মাসে ১ লাখ টাকা আয় করেন।
আফসানার স্বামী সিহাবুর রহমান বলেন, চাকুরি হারানোর পর নানা চিন্তায় পড়েছিলাম । নিজের ঘরে ঠিক মতো খাবার জোগাড় করতে পারতাম না। নানা জটিলতার মধ্যে ছিলাম । সে কারণে স্ত্রীর পরামর্শে এই আচার তৈরির কাজে সহযোগিতা করি। এখন সেই বেকার জীবন কেটে গেছে আমাদের। মাসে এক লাখ টাকা কর্মীদের বেতন দিয়েও আরো দুই লাখ টাকা মুনাফা করি।
শুধু নিজের পরিবারের স্বচ্ছলতাই নয়, আফসানার প্রতিষ্ঠানে এখন ১২ জন নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আচারি ফুড নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন পেজে প্রচার করে ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন। আগামীতে আফসানা বড় পরিসরে আচারের কারখানা স্থাপন করতে চান।
বগুড়া শহরের সেউজগাড়ী এলাকার বাসিন্দা আফসানা-সিহাবুর দম্পতি এখন এলাকায় জীবন যুদ্ধ জয়ের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। হয়ে উঠেছেন অনলাইন ব্যবসার আইকন।
বাসসের সাথে আলাপকালে সেই সাফল্যের গল্পই শোনালেন আফসানা, ‘২০২০ সালে করোনাকালে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আমার স্বামী সিহাবুর রহমানের চাকরি চলে যায়। তখন অভাবে দিশেহারা হয়ে পড়ি। চাকরি যাওয়ার পরে সংসারে পর্যাপ্ত খাবারও ছিল না। জীবনধারণের জন্য অন্যরকম কিছু একটা অবলম্বন খুঁজতে থাকি।’
তিনি বলেন, তখন ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন কাজের সফলতা দেখে রান্নায় উৎসাহিত হই। সিদ্ধান্ত নেই ব্যবসা করবো। পুঁজি ছিলো না। তখন আমার সখের মোবাইল ফোনটি বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা পাই। সেই টাকা দিয়েই গরুর মাংসের আচার তৈরি করে ব্যবসা শুরু করি।
প্রথমে বিক্রি কম হলেও ধীরে ধীরে তার সুস্বাদু মাংসের আচারের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আচারি ফুড নামে অনলাইন পেজে (https://www.facebook.com/share/15gSVVQNJe/?mibextid=wwXIfr) প্রচার করে ব্যাপক সাড়া পান তিনি। আফসানা ও তার স্বামী আচার তৈরির পাশাপাশি অনলাইন পেজে তাদের আচারের প্রচারণা করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আচারের অর্ডার আসতে থাকে।
আফসানার আত্মপ্রত্যয় আর স্বামীর সার্বিক সহায়তায় এখন তারা সফল আচার ব্যবসায়ী। ক্রমে বগুড়ার গন্ডি পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে তার আচারের সুনাম। এক সময় দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আচার পা বাড়ায় বিশ্ব দরবারে। এখন সৌদি আরব, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে আচার বিক্রি করছেন আফসানা।
আফসানা এখন গরুর মাংসের আচার, রসুনের আচার, তেতুলের আচার, জলপাইয়ের আচার, আমের আচার, বড়ইয়ের আচার, আলুবোখারার আচার, চালতার আচার, কাঁচা মরিচের আচার ও শুকনা মরিচের আচার তৈরি করছেন। বাজার থেকে মাংস কিনে তা থেকে হাড় ও চর্বি বাদ দিয়ে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে চুলায় মাংস সেদ্ধ করে হরেক রকমের মসলা দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মাংসের আচার। পানির ব্যবহার নেই বললেই চলে। খাঁটি সরিষার তেল ব্যবহার করা হয় আচার তৈরিতে।
আফসানার প্রতিবেশি জোনাকী আকতার বাসসকে বলেন, আগে কত কষ্টই না করেছে আফসানা। এখন সে গরুর মাংসের আচার তৈরি করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে। প্রতিবেশি হিসাবে আমার গর্ব হয়। তাই বলছি চাকুরির পিছে না ঘুরে নিজে কিছু করলে সাফল্য অর্জন করা যায়।
আফসানার আচার নিয়মিত ক্রয় করেন বগুড়া শহরের চারমাথা শান্তাহার রোডের আবাসিক হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট ‘হোটেল বগুড়া টুডে’ -এর স্বত্তাধিকারী আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, আমাদের কাছে আরও অনেকেই ওই ধরনের আচার সরবরাহ করতে চান। কিন্তু আফসানার আচারের রেসিপি ভিন্নরকম। আমাদের রেস্টুরেন্টে সকলের কাছে তার আচারের কদর বেশি। এজন্য আমরা নিয়মিত আফসানার আচার সংগ্রহ করে থাকি।
আচার তৈরি করেই স্বনির্ভর হয়েছেন উদ্যোক্তা আফসানা নীরা। তিনি জানান, এখন প্রতি মাসে প্রায় তিন লাখ টাকার আচার বিক্রি করেন। তার সাথে কাজ করেন ১২ জন নারী।
আফসানা নীরা জানান, এখন তিনি ব্যস্ত থাকেন আচার তৈরি ও বিক্রি নিয়ে। আচারি ফুড নামে অনলাইন পেজে প্রচার করে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছেন। ছুটির দিন ছাড়া মাসজুড়ে ১০০ কেজি গরুর মাংসের আচারসহ অন্য আচার বিক্রি করেন ১ হাজার কেজিরও বেশি। আগামীতে বড় পরিসরে আচারের কারখানা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। বগুড়ার গৃহবধু থেকে উদ্যোক্তা আফসানা এখন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছেন।
তিনি বলেন, আচারের ব্যবসা শুরুর করার পর থেকেই গ্রাম উন্নয়ন কর্ম (গাক) থেকে কিস্তিভিত্তিক ঋণ নিয়েছিলাম। সেই ঋণ এখনো চলমান রয়েছে। বর্তমানে তাদের ডেইরী প্রকল্পে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে। তারা আমাকে কারখানা করার জন্য আর্থিক সহায়াতা প্রদান করবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।
স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রাম উন্নয়ন কর্ম (গাক)-এর কর্মকর্তা আরমান হোসেন বাসসকে বলেন, আমরা তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছি। মুলধন তৈরির ব্যবস্থা করেছি। তার আচার দেশে এবং দেশের বাইরে বিক্রিতে সকল প্রকার সহযোগিতা করে যাচ্ছি।
অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টা কয়েক বছরে তার জীবন বদলে দিয়েছে। বগুড়া জেলা ও রাজশাহী বিভাগ থেকে সরকারিভাবে সফল নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পেয়েছেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকরি প্রশিক্ষণও।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর বগুড়ার উপপরিচালক মো. তোছাদ্দেক হোসেন বলেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আফসানা এখন সফল উদ্যোক্তা। শহরে নিজ বাড়িতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। এতে নারী সমাজের অর্থনৈতিক মুক্তি ও নারী নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন। এখন অনেকেই তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন।
পাঁচ বছরের চেষ্টায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আফসানা-সিহাবুর দম্পতি। আট বছর বয়সী একমাত্র কন্যা মোছা. আয়শা সাদিকা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দুঃস্বপ্নের দিন পেরিয়ে সুখেই আছেন তারা।