শিরোনাম
চুয়াডাঙ্গা, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫ ( বাসস) : লেখাপড়া শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে সমন্বিত খামার গড়ে স্বাবলম্বী হয়েছেন চুয়াডাঙ্গার হাফেজ আব্দুল কাদির সোহান। বর্তমানে জেলা জুড়ে রয়েছে তার খ্যাতি। এরই মধ্যে গত ৮ বছরে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন থেকে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেছেন।
হাফেজ আব্দুল কাদির সোহান চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর মহিলা কলেজ পাড়ার বাসিন্দা। ২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে সোহান সবার ছোট। এ কারনে তিনি বাবা মায়ের খুব আদরের। বাবা জোনারুল ইসলাম ও মা গুলশান আরা বড় শখ করে তাকে কোরানে হাফেজ পড়িয়েছেন। ২০০৩ সালে হাফেজ পাস করার পর ২০১০ সালে চুয়াডাঙ্গা সিনিয়র আলিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করেন। পরে ২০১৫ সালে এস এম জোহা কলেজ থেকে কৃষি ডিপ্লোমা অর্জন করেন। শুরু করেন বেসরকারি কীটনাশক কোম্পানি চাকরি। দুই বছর চাকুরী করার পর চাকুরীতে মন বসেনি সোহানের। এরপর পাকাপোক্ত সিদ্ধান্ত নেন চাকুরী ছেড়ে সমন্বিত খামার গড়ার।
২০১৭ সালে পিতার দেওয়া মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা ও দুই বিঘা জমি দিয়েই সমন্বিত খামার গড়ে তোলেন। শুরুতে ১২ মাসি কাটিমন আম, থাই পেয়ারা ও থাই লেবু দিয়ে ব্যবসার গোড়া পত্তন। ২০১৮ সালে সোহান সারা দেশে কাটিমন আম উৎপাদন করে দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ২০১৯ সালে ব্যবসা সম্প্রসারিত হলো। চাষের জমি ২ বিঘা থেকে বেড়ে ৬ বিঘা হলো। ক্রমেই ব্যবসা লাভবান হওয়ায় সোহানের ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে । ২০২০ সালে এসে জমির পরিমাণ দাঁড়ালো ২১ বিঘা। বর্তমানে সোহানের সমন্বিত খামারে মোট জমি রয়েছে ৩০ বিঘা।
আব্দুল কাদের সোহান বিবাহিত। তার স্ত্রী শারমিন সুলতানা গৃহিণী। তাদের ঘর আলোকিত করে রেখেছে মেয়ে মনমিলা ও জামিলা। সোহানের সফল উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে স্ত্রী শারমিনের নিরলস পরিশ্রম রয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বুজরুক গড়গড়ি এলাকায় সোহান গড়ে তুলেছেন সমন্বিত কৃষি খাবার। নাম দেওয়া হয়েছে মনমিলা গার্ডেন এন্ড নার্সারী। গত শনিবার বিকেলে সোহানের খামারে গিয়ে দেখা যায়, খামারে প্রবেশ মুখে দুই পাশে ৩ টি পুকুর। সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পানিতে সাঁতরাচ্ছে । পুকুরের চারিধারে ফুলের বাগান। আরো একটু সামনে এগোলেয় বাগানে নানান ধরনের ফল গাছের সমাহার। বারো মাসি আম, কাঁঠাল, কুল, চাইনিজ কমলা, দার্জিলিং কমলা, থাই পেয়ারা, ড্রাগন, বারি-১ মাল্টা, এ্যাভোকাডো, রামভূটান, ডুরিয়ান, পার্সিমোন, থাই সরিফাসহ ৮০ প্রজাতির ফল গাছ রয়েছে। প্রতিদিনই ফল বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের গাছের চারা বিক্রি করা হয়। উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এখানে তৈরি করা হয়েছে চালা ঘর। মনমিলা গার্ডেন থেকে চারা কিনে বাগান করে অনেকে নারী -পুরুষ বেকারত্ব ঘুচিয়েছেন।
এর বাইরে গত ২ বছর আগে গরু পালনের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে টিনের সেড। সেখানে ১০টি গরু মোটা তাজা করণ করা হচ্ছে।
তরুণ উদ্যোক্তা হাফেজ আব্দুল কাদের সোহান বলেন, চাকুরি করবো না, চাকরি দিবো। গাছ দিয়ে মানুষের সেবা করা যায়, সেইজন্য কৃষি সেক্টরে আমার আসা। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন ফসলের জাতকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া তার প্রধান লক্ষ্য। ৮০ প্রজাতির ফলের গাছের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভজনক কাটিমন বারো মাসি আম ও চাইনিজ কমলা। কাটিমন প্রতিকেজি আমের দাম ১০০/২০০ টাকা। প্রতিটি গাছের মূল্য ১৫০ টাকা। ১ বিঘা জমিতে একশ গাছ লাগানো যায়। আমার কাছ থেকে আমের চারা নিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৫/৫০ জন বাগান করে তারাও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। এর বাইরে চাইনা কমলা ও গাছ বিক্রি করে অনেক লাভবান হয়েছি। আমার কাছ থেকে গাছ নিয়ে ৩০/৩৫ জন ব্যক্তি কমলা বাগান করে তারা আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন।
বর্তমানে আমার খামারে ১২ জন শ্রমিক কাজ করছে। কর্মচারিদের বেতন ও বিদ্যৎ বিল বাবদ খরচ হয় ৬৫/৭০ হাজার টাকা। প্রতি মাসে খরচ বাদে ৯০ /৯৫ হাজার টাকা লাভ থাকে। আগামীতে আমার খামারে ৫০ জন ব্যক্তির কর্মসংস্থান হয় সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। ২০২৪ সালে আমার এ খামারে মোট বেচাকেনা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। একই সময়ে খরচ হয়েছে ৯ লাখ টাকা।
সোহান আরো বলেন তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি। এরমধ্যে ২০১৯ সালে শ্রেষ্ট তরুণ কৃষি উদ্যোগ পুরস্কার, ২০২০ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষক পুরস্কার, ২০২২ সালে শ্রেষ্ট নার্সারী পুরস্কার, ২০২৩ সালে কৃষি মেলায় শ্রেষ্ট উদ্যোক্তা পুরস্কার ও ২০২৪ সালে যুব দিবসে সফল উদ্যোক্তাসহ একাধিক পুরস্কার লাভ করেছেন। আমি আমার মা, বাবা, স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে সচ্ছলভাবে জীবন যাপন করছি। চলতি জানুয়ারি মাসে জেলার ৪ উপজেলার উদ্যোক্তাদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠন করা হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে চুয়াডাঙ্গা উদ্যোক্তা উন্নয়ন ফোরাম। ১০ সদস্যের আহবায়ক কমিটিতে আমাকে করা হয়েছে আহবায়ক।
এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা সোহান লেখাপড়া শেষ করে মনমিলা গার্ডেন এন্ড নার্সারি নামক সমন্বিত খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি নিজে যেমন কর্মসংস্থান করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তেমনি বেশ কিছু নারী পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। সে আমাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের দপ্তর পৃর্বের থেকে তাকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসছে। সেই পরামর্শ কাজে লাগিয়ে সর্তিকার অর্থে সে একজন ভালো উদ্যোক্তা। এলাকার বেকার যুবকদের আইডল হিসেবে কাজ করছে সোহান।