বাসস
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭:২১

খাগড়াছড়ির বীনা রাণী ত্রিপুরা সেলাই মেশিনে স্বপ্ন বুনে চলেছেন

সমাজের বঞ্চিত নারীদের সেলাই শেখানোর জন্য দুয়ার খোলা খাগড়াছড়ির বীনা রাণী ত্রিপুরা সেলাই মেশিনে স্বপ্ন বুনে চলেছেন। ছবি ; বাসস

\ জীতেন বড়ুয়া \

খাগড়াছড়ি, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বীনা রাণী ত্রিপুরা (৩৮)খাগড়াছড়ির সফল সংগ্রামী নারীর নাম।এ নারী দুই দশক ধরে সেলাই মেশিনে স্বপ্ন বুনে চলছেন।

এক সময়ে নৃত্যাঙ্গনের কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল তার। নৃত্যশিল্পী হিসেবে পারফর্মেন্স করেছেন অনেক জাতীয় কর্মসূচিতেও।সংসার জীবনে পরাজিত এ নারীর দুটো ছেলে-মেয়ের জন্মের পর থেকেই সংসারে নেমে আসে অশান্তি। অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একা বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেন।সেই থেকে সেলাই মেশিনে দুই দশক ধরে স্বপ্ন বুনে চলেছেন বিনা ত্রিপুরা। তৈরী করেছেন শুধু ব্যবসায়ের ঠিকানাই নয় অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থানের ঠিকানাও। বিনার’র গল্প শুধু সফলতার নয় জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ারও।২০১৫ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু হয় তার পথচলা। সম্ভাবনাময় বিনাকে পরবর্তীতে আরো দু’ দফায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। একটি  ব্লক-বাটিক, অপরটি বিউটিফিকেশন। শুধু প্রশিক্ষণই নয় যুব উন্নয়ন তাকে যুব ঋণ দিয়েছে, দিয়েছে উদ্যোক্তা ঋণ। যুব উন্নয়নের সকল প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।একা লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়ে বীনা এখন স্বাবলম্বী নারী। সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে  ২০১৮ সালে ছিনিয়ে এনেছেন ‘জাতীয় যুবপদক ২০১৮’।

খাগড়াছড়ি জেলা শহরের কাছাকাছি খাগড়াপুর গ্রামে  তার জন্ম। বাবা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক আর মা গৃহিণী। বেড়ে ওঠা খাগড়াপুরেই। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মা-বাবার ইচ্ছেতে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্বামীর সংসারে পা রাখেন বীনা ত্রিপুরা।কিন্তু ২ ছেলে মেয়ে জন্মের পর সংসার আলাদা হয়ে গেলো । এক সময় শখের বসে ঘরে সেলাই কাজ করলেও সেই সেলাই কাজই আজ তাকে খাগড়াছড়ির রাণী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। 

স্বামীর ডিভোর্সের পর যখন দুই সন্তান নিয়ে হতাশা ডুবে যাচ্ছিলেন তখনই প্রতিবেশী এক মাসির (খালা) পরামর্শে ২০১৫ সালে যুব উন্নয়ন অধিদফতরের ছয়মাস মেয়াদি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শেষ করেই খাগড়াপুরের একটি ভাড়া বাসায় ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’ দিয়ে নতুন করে সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। 

এসময় যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা আর প্রতিবেশী চন্দনা ত্রিপুরা ২০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।এ ছিল তার মূলধন। সামনে দোকান আর পেছনে ছেলে-মেয়ে-সহকর্মীদের নিয়েই বীনা’র ঘর ও সওদাপাতি। ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ শত নারী তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শিখে পরিবারের অবদান রাখছেন। শিক্ষাজীবন থেকে ঝড়ে পড়া, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যক্তা; এমন অসহায় নারীরাই ভিড় করেন বীনা’র কেন্দ্রে।এখন বীনা ত্রিপুরা’র ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’-এর পুঁজি ১০ লাখ টাকার চেয়েও বেশি। গড়ে প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।

ছয়মাস বিনামূল্যে কাজ শেখার পর শেষে একবছর বেতনের বিনিময়ে তাঁর সেন্টারে কাজ করার এ সহজ শর্তেই এগিয়ে যাচ্ছে ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’।
এখন জেলা নয় সারাদেশের পরিচিত এক প্রতিষ্ঠানের উদ্যেক্তা বীনা ত্রিপুরা।মহিলা ও শিশুদের পোশাক তৈরী এবং পোশাক বিক্রয় কেন্দ্র ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’।অন্য যে কোন টেইলার্স বা শপিং সেন্টার থেকে এটি ব্যতিক্রম। কেন ব্যতিক্রম? সালোয়ার-কামিজগুলো আকর্ষণীয়, তৈরী করে দেওয়া পোশাকের মানটা একটু সুন্দর। এ রহস্য সম্পর্কে বীনা ত্রিপুরা জানান, আমি নিজেই মাসে দু’বার ঢাকা যাই, পছন্দ করে পোশাক কিনে নিয়ে আসি। আর তৈরী করা পোশাক কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে তবে তৈরী করি-যা কেউ করে না।এ ছাড়া পাহাড়ী পোশাকে নিজস্ব ডিজাইন তো রয়েছে ।

প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। এ কাজে পেশাদারিত্ব আছে বলেই, হয়তো আছে সফলতা। টেইলরিং শাখায় এখন কাজ করছেন পাঁচজন নারী। কাজের উপরে তাদের পারিশ্রমিক। অনেকের উপার্জন আট থেকে দশ  হাজার টাকা পর্যন্ত।

এদিকে বীনা ত্রিপুরা আরো বলেন, একাকী জীবনে আসার পর থেকেই সমাজের ভালো-মন্দ সব মানুষের মুখেই নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা শুনতে শুনতে এগোচ্ছি। নারীদের জন্য প্রকৃত অর্থেই এ সমাজ বৈরী। শুরুর দিকে স্থানীয় গীর্জা থেকে একটি সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছিল। এখন নিজেকে নিয়ে অনেক স্বস্তিতে চলি। ভালো আছি নিজে এবং অন্য অনেক নারীকে আলো’র পথে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

নিজের স্বপ্ন বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সমাজের বঞ্চিত নারীদের সেলাই শেখানোর জন্য দুয়ার খোলা রেখেছি। এখনও প্রতিদিন সাতজন বিভিন্ন বয়সী নারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ কাজ শেখার পর নিজেরাও বাসাবাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে আয় করছেন।

তাঁর মতো বিপদগ্রস্তদের প্রতি একটিই আহ্বান, সব নারী যেন ঘর সংসারের পাশাপাশি নিজের কর্মদক্ষতাকে শাণিত রাখেন। স্বামী অথবা অন্যদের ওপর নির্ভরতার বাইরে কিছু একটা করার প্রত্যয় রাখেন। তাহলে সমাজে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং মর্যাদার ভারসাম্য টিকে থাকবে।

আমাদের সমাজে সংসারে বা যৌথ পরিবারের সব পুরুষই আসলে প্রথাগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি নারীরাও। এ যেমন আমি নির্যাতিত হতে হতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেলাম। জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। জীবনের প্রতি হয়ে পড়ি বীতশ্রদ্ধ। অথচ নিকটাত্মীয় নারীরাও খুব বেশি আমার পাশে দাঁড়াননি। সব দোষ ঘাড়ে নিয়ে সমাজের নানা বঞ্চনা মাথায় নিয়ে আজকের বীনা হয়ে উঠেছি। ২০১২ সালে পিত্তথলির অপসারণ করার পর থেকেও সংসার ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হযেছিল। শরীরে এখনও বহন করছি সাংসারিক জীবনের শারীরক নির্যাতনের অনেক চিহ্ন।

তবু বলবো, বুকে সাহস-সততা-শক্তি এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে কারো দিন কারো জন্য আটকে থাকে না। 

শেষবারও যদি বলি, ‘যে জীবন একা, সে জীবন লড়াইয়ের’।বিয়ের ১৮ বছরের মাথায় ২০১৫ সালে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একলা পথ চলা শুরু করে বীনা রাণী ত্রিপুরা।শুধু মায়ের ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠা মেয়ে হেমী ত্রিপুরা(১৮) পড়ছে ঢাকার একটি নামকরা কলেজে আর একমাত্র ছেলে অর্কিড ত্রিপুরা (২০)ঢাকায় পড়ছে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ।একলা পথে হাঁটতে হাঁটতে এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী বীনা রাণী এখন ‘সংসার ভাঙা এক সফল নারী’।
বর্তমানে খাগড়াছড়ি সদরের তৈবাকলাই-গাছবানের মতো দুূর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অনেক নারী আসেন। 

এছাড়াও দূরের সাজেক-দুর্গম তৈচুই থেকে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কিশোরী-ছাত্রীরা।

কথা হয় জেলা সদরের ইসলামপুরের মুন্নী আকতার ও পুতুল, কুমিল্লা টিলার জয়নব আকতার, নাসরিন আকতারের  সঙ্গে।যারা‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’ থেকে কাজ শিখেই হাঁটছেন আয়ের পথে। নিজের ঘরে সেলাই ছাড়াও অর্ডার পাচ্ছেন পাড়া-প্রতিবেশীরও।

বীনা’র বাসায় থেকে একই সঙ্গে সেলাই এবং সরকারি মহিলা কলেজে পড়ছেন সরেন্দ্রী ত্রিপুরা। একই  সঙ্গে লেখাপড়া আর কাজ শিখছেন জলিতি ত্রিপুরা।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা নিরোপন চাকমা বলেন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে সফলতা পেয়েছেন অনেকেই। তবে বীনা ত্রিপুরা একটি দৃষ্টান্ত।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর খাগড়াছড়ি জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক আইরীন আক্তার বলেন, সফল উদ্যোক্তা বীনা ত্রিপুরা  শুধু সফলই হননি, অন্যদের স্বাবলম্বী করতে সতত সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। তাঁর ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ”হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’’ যেন বাতিঘর। আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি পাহাড় থেকে পাহাড়ে।