বাসস
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:৪০

অদম্য মনোবলে এগিয়ে যাচ্ছেন  চাঁদপুরের তরুণ উদ্যোক্তা আকাশ

নিজেকে তুলে ধরছেন আপন কাজের মাধ্যমে  চাঁদপুরের তরুণ উদ্যোক্তা আকাশ। ছবি ;বাসস

চাঁদপুর , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫( বাসস) : সাইফুল ইসলাম আকাশ (৩৪) অদম্য মনোবলে এগিয়ে যাচ্ছেন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে। নিজেকে তুলে ধরছেন আপন কাজের মাধ্যমে। 

একসময় দারিদ্রতার কারনে পড়াশোনার পাশাপাশি ৪০০ টাকা বেতনে কাজ নেন স্টুডিওতে। বর্তমানে নিজের প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন ডিজিটাল প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান ‘এমআই আইটি সেন্টার’। এ প্রতিষ্ঠানে কর্ম সংস্থান হয়েছে আরেক যুবকের। কাজের সুনাম ও দক্ষতায় এখন তার মাসিক আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।

কথা বলে জানা যায় ,শহরের নতুন বাজার বেগম মসজিদ সংলগ্ন জেএম সেনগুপ্ত রোডে ১৯৯০ সালে জন্ম হয় সাইফুল ইসলাম আকাশের। বাবা হাসান প্রধানিয়া ও মা আসিয়া বেগম। পৈত্রিক বাড়ি জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজিকান্দি ইউনিয়নের আমিরাবাদ প্রধানিয়া বাড়ি। বহু বছর আগেই মেঘনার ভাঙনে ওই বাড়ি নদীটি  বিলীন হয়। তারপর থেকে পুরো পরিবার শহরে থাকেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে সাইফুল কনিষ্ঠ। বড় ভাই আহসান উল্ল্যাহ(৫০) একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। মেজ ভাই বাবলু (৪৫) ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি সেখানেই স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন।

বড় ভাইয়ের আয়ে তাদের সংসার চলতো এক সময়। কারণ বাবা হাসান প্রধানিয়া তাদেরকে ছোট রেখে অন্যত্র চলে যান। তবে মাঝে মধ্যে এসে দেখা করেন। বড় ভাইয়ের দায়িত্বে তাদের বেড়ে উঠা।

আকাশের সংসারে এখন মা, স্ত্রী ও দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এরমধ্যে বড় সন্তান মোবাশ্বেরা ইসলাম চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। আর ছোট সন্তান ফারিস্তা ইসলামের বয়স ৩১ মাস।

আকাশ বলেন, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন বাসার পাশের কদমতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ডিএন উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৬ সালে সে কাজ নেন ৪০০ টাকা বেতনে শহরের এস আলম কালার ল্যাব নামে স্টুডিওতে। কাজের পাশাপাশি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১০ সালে মাধ্যমিক, ২০১৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক ও ২০১৭ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তার জীবন সংগ্রামের এটি একটি বড় অধ্যায়।

তিনি আরো বলেন, ২০০৭ সালে এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে তার কম্পিউটারে টুকটাক কাজ শিখতাম। সেই থেকে কম্পিউটারের হাতে খড়ি। তারপর সময় পেলেই তার বাসায় গিয়ে কাজ শিখতাম। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করাতে অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। টানাটানির সংসারে চলতে খুব কষ্ট হয়। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে ২০১২ সাল পর্যন্ত একাধিক প্রতিষ্ঠানে ছবি এডিটিংয়ের কাজ করি। তবে সম্মানি ছিলো কম। কিন্তু এরই মধ্যে ২০১১ সালে পারিবারিকভাবে পূর্ব পরিচিত দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সানজিদা সাথীর সঙ্গে বিয়ে হয়।

আকাশ বলেন, ২০১২ সালে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে স্ত্রীর নামে ঋণ নিয়ে একটি কম্পিউটার ক্রয় করি। তখন থেকে বাসায় প্রিন্টিংয়ের ছোট ছোট কাজ করে কম্পিউটারের কিস্তি পরিশোধ করি। এরই মাঝে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রিন্টিং ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানেও কাজ করতে হয়। আইটি বিষয়ে আমার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকায় অধিকাংশ সময় অন্যদেরকে অনুসরণ করি এবং ইজিপি টেন্ডার সিস্টেমের ওপর প্রশিক্ষণ নেই। 

সর্বশেষ আমার বেতন ছিল ১৫ হাজার টাকা। যা দিয়ে সংসার চলতে খুব কষ্ট হতো।

আকাশের জীবনের বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ আসে করোনা মহামারির সময়। ওই সময় তিনি বেকার হয়ে পড়েন। 

লকডাউনের সময় স্ত্রীর পরামর্শে এক বন্ধুর কাছ থেকে পাওনা ৫ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে কিছু হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের প্রতিরোধী বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র  বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরবারহ করেন। করোনার ভয়াবহতা কিছুটা কমে আসলে স্ত্রীর উৎসাহে শহরের কদম তলায় পৌরসভার মার্কেটে ১ হাজার টাকায় ভাড়া নেন দোকান। আর সেখানেই গড়ে তোলেনর স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান ‘এমআই আইটি সেন্টার’।

আকাশ বলেন, কাজ শুরু করি নিজের কম্পিউটার দিয়ে। এক বড় ভাই প্রিন্টার কিনে দেন। আরেকজনের সহযোগিতায় পাশের দোকান থেকে বাকীতে নেয়া হয় প্রতিষ্ঠানের আসবাবপত্র। শুরু হয় আমার নতুন করে পথচলা। শহরের পূর্ব পরিচিত লোকজন আমাকে অর্ডার দিতে থাকে। তাদের বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, ভিজিটিং কার্ড, মোমো, ডিজিটাল সাইন, আইডি কার্ড,  বিভিন্ন ধরনের রশিদ ছাপানো, স্কুল কলেজের বিভিন্ন ধরনের কাজ আসতে থাকে আমার দোকানে। এর বাইরে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের আবেদন করার কাজ করি, গড়ে আমি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত কাজ করি।

আকাশ আরো বলেন, একসময় আমার প্রতিষ্ঠানে কাজের অর্ডার আসতো ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত মাসে। 

কিন্তু গত কয়েক মাস একটু কমেছে কাজের অর্ডার। বর্তমানে মাসে খরচ বাদে আয় ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। 

পরিবার নিয়ে ভালো আছি। জীবনের কতবার যে ছিটকে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে তা আমি বলে বুঝাতে পারবোনা। ছোটবেলা থেকেই সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে আমাকে। তবে ধৈর্য্য আমাকে এগিয়ে এনেছে। তাই তরুণদের ধৈর্য্য ও মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করবো।