শিরোনাম
\ মো. মামুন ইসলাম \
রংপুর, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : অধ্যবসায়, ধৈর্য এবং কঠোর পরিশ্রমের পথ অনুসরণ করে ৩৬ বছর বয়সী যুব উদ্যোক্তা মো. আব্দুল বারী দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র কাটিয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার বেতগাড়ি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত বেতগাড়ি মুহুরীপাড়া গ্রামে একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে বারী জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তাদের পরিবারের নয় সদস্যের সাথে বেঁচে থাকার জন্য তাকে অবর্ণনীয় সংগ্রাম করতে হয়েছে।
সেই হতদরিদ্র বারী সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে এখন স্বাবলম্বী হয়ে স্থানীয় যুবকদের কাছে একজন আইকন হয়ে উঠেছেন।
বারীর বাবা মো. মাহতাব উদ্দিন স্থানীয় বেতগাড়ী জামে মসজিদে খাদেম হিসেবে কাজ করতেন। তিনি বহু বছর ধরে বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের ধানক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করে দিয়ে সামান্য কিছু আয় করতেন। কিন্তু তার এ আয় দিয়ে সংসার চলত না। তিনি ২০২১ সালে মারা যান। মা মোছা. শাহার বানু (৭০) এখন বয়সের ভারে ক্লান্ত। বারী তার বাবা-মায়ের তিন ছেলে এবং চার মেয়ের মধ্যে তৃতীয়। বারীর বড় ভাই শাখাওয়াত হোসেন শাহীন, (৫০), এবং ছোট ভাই মো. শাহজাহান, (৩০), ঢাকায় দুটি পৃথক বেসরকারি কোম্পানিতে ড্রাইভার হিসেবে কম বেতনে চাকরি নিয়ে সেখানে বাস করেন। তার চার বোনের সকলেই বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে বাস করছেন।
দারিদ্রের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন তার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য বারীকে তার এলাকার বিভিন্ন চায়ের দোকান এবং বাড়িতে শ্রমিক এবং গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে হয়। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি স্থানীয় ছাত্রদের টিউশন করে তার পরিবারের ভরণপোষণে সহায়তা করেন।
বারী এখন তার চারটি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি), একটি নার্সারি, একটি অনলাইন ব্যাংকিং সেন্টার এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দোকান। সেখানে এখন আটজন লোক কর্মরত আছেন।
বাসস’র সাথে সম্প্রতি আলাপকালে বারী প্রায়শই তার সাফল্যের গল্প বর্ণনা করতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন। দারিদ্রের কারণে সেই দিনগুলোতে তার পরিবারের সদস্যদের অনাহারেও থাকতে হত।
একদিন বারীর সাথে তার পূর্ব পরিচিত নিকটবর্তী বকশীগঞ্জ বাজারের বাসিন্দা ব্যবসায়ী শাহিনুর রহমান পিন্টুর দেখা হয়।
পিন্টু তাকে কম্পিউটার দক্ষতা অর্জনের জন্য তার প্রতিভা ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। ২০০১ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বারীকে পিন্টু তার ব্যবহৃত একটি পেন্টিয়াম-৪ ডেস্কটপ কম্পিউটার দেন।
বারী বলেন, “কম্পিউটার ব্যবহার করতে না জানলেও আমি এটি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। শিগগিরই আমি নিজে নিজেই কম্পিউটার চালানো শিখে ফেলি।”
এর মধ্যে বারী ২০০৪ সালে স্থানীয় ধনতলা রিয়াজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষা (বিজ্ঞান) দিয়ে পাস করেন।
বারী বলেন, “কিন্তু দারিদ্রের কারণে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। পরে আমি ২০০৯ সালে এইচএসসি (বাণিজ্য) পরীক্ষায় একই প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তীর্ণ হই।”
আবারো পড়াশোনা বন্ধ থাকার পর বারী ২০১৪ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি (বাণিজ্য) সম্পন্ন করেন।
২০০২ সালে বারী স্থানীয় বেতগাড়ী বাজারের 'আনন্দ স্টুডিও' থেকে ছবি তোলা, ফিল্ম প্রসেসিং এবং ফটোকপিসহ ফটোগ্রাফির প্রক্রিয়া শিখেন। পরে তিনি ডিজিটাল ফটোগ্রাফিও শিখেন।
বারী বলেন, “তারপর ২০০৩ সালে আমি বেতগাড়ী বাজারে 'নিশি কম্পিউটারস' নামে একটি দোকান খুলি। পরবর্তীতে আমি একই দোকানে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং বৈদ্যূতিক সামগ্রী বিক্রয়ের ব্যবসায় শুরু করি। আমার আয় বাড়তে থাকে।”
২০১০ সালে বেতগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. নুরুল আমিন বারীকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেতগাড়ী ইউডিসির উদ্যোক্তা হিসেবে নিযুক্ত করেন। এটি বারীর জীবনের অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
বারী বলেন, “পরে আরেকজন মহিলা উদ্যোক্তা ফেরদৌসী খাতুনকে ইউডিসিতে নিযুক্ত করা হয়। আমরা দু’জনে মিলেই স্থানীয়দের সেবা প্রদান শুরু করি। শুরুতে দৈনিক আয় ছিল মাত্র দেড়শ’ টাকা থেকে তিনশ’ টাকার মধ্যে।”
২০১৫/২০১৬ সাল থেকে আয় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তখন ইউডিসিতে পরিষেবার সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ফলে প্রতি মাসে আয় ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় উন্নীত হয়।
এদিকে সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বারী ২০১৭/২০১৮ সালে তার ইউডিসিতে আরও দুজন সহকারী নিয়োগ করেন। জনগণ সেখানে এখন একশ’ ৩০ প্রকারের সেবা পেয়ে থাকেন।
বারী বলেন, “বর্তমানে তিন সহকারীর মোট মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য খরচ ১৫ হাজার টাকা বাদে ইউডিসি থেকে তার গড় মাসিক নিট আয় ৩০ হাজার টাকা।”
ইতোমধ্যে বারী তার দোকান 'নিশি কম্পিউটারস' এ দুটি ব্যাংকের সাথে অনলাইন এজেন্ট ব্যাংকিং ছাড়াও বিকাশ, রকেট, নগদ এবং উপায় মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবা পরিচালনা করছেন। সেখানে তার মোট বার্ষিক লেনদেন প্রায় ৩ কোটি টাকা।
বারী বলেন, “আমি প্রতি মাসে মোবাইল এবং অনলাইন এজেন্ট ব্যাংকিং পরিষেবা থেকে দুই কর্মচারীর মাসিক বেতন বাদ দিয়ে ২০ হাজার টাকা আয় করি।” একই দোকানে বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রি করেও তিনি কিছুটা আয় করেন।
ইউডিসি এবং বৈদ্যুতিক পণ্যের দোকান এবং মোবাইল এবং অনলাইন ব্যাংকিং পরিষেবা পরিচালনার পাশাপাশি বারী ২০১৯ সালে নিকটবর্তী খাফরিখাল সরদারপাড়া গ্রামে দুই একর জমিতে তার নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন।
বারী বলেন, “বর্তমানে, নার্সারিতে ৪৫ প্রজাতির বিভিন্ন কাঠ, ফল, ফুল এবং ঔষধি গাছের প্রায় ৩০ হাজার বাড়ন্ত চারা রয়েছে। এই চারাগুলির সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা হতে পারে।”
বারী এখন পর্যন্ত ১৫ লক্ষ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। এ বছর ছয় লক্ষ টাকার চারা বিক্রি করার আশা করছেন। চারজন পুরুষ ও মহিলা নার্সারিতে কাজ করছেন এবং তারা প্রত্যেকে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে মজুরি পাচ্ছেন।
বারী বলেন, “সকল খরচ বাদে আমি প্রতি মাসে নার্সারি থেকে ২০ হাজার টাকা নিট মুনাফা পাই।”
বারী বলেন, ইউডিসি, কম্পিউটার কাম ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকান, মোবাইল ব্যাংকিং এবং অনলাইন এজেন্ট ব্যাংকিং এবং নার্সারি থেকে সমস্ত খরচ বাদে তার গড় মোট মাসিক আয় এখন প্রায় ৭০ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, “আমি ৮০ লক্ষ টাকার সহজলভ্য ঋণ পেলে আমার ইউডিসিতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পুনরায় চালু এবং সেখানে সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারণ করতে পারব। একটি গবাদি পশুর খামার ও নেপিয়ার ঘাস চাষ প্রকল্প চালু এবং মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সম্প্রসারণ করে যুবকদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারব।”
নিকটবর্তী গ্রামের মাস্টার্স পাশ ৩২ বছর বয়সী মুন্নি খাতুনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর বারী ২০১৫ সালে তাকে বিয়ে করেন। বর্তমানে মুন্নি খাতুন বারীর সাথে বেতগাড়ী ইউডিসিতেই একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করছেন।
এই সুখী দম্পতির একটি মেয়ে আফিয়া ইবনাত মুসকান (৬) এবং একটি ছেলে আনাস (২) রয়েছে। মা মোছা. শাহার বানু ও দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে সুখে দিনযাপন করছেন বারী-মুন্নি দম্পতি।
বাসস’র সাথে আলাপকালে বেতগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাইমিন ইসলাম মারুফ বলেন, আব্দুল বারী তার সার্বিক পারফরম্যান্স, ইউডিসি পরিচালনা এবং সাধারণ মানুষকে সেবা প্রদানে অর্জিত সাফল্যের মাধ্যমে এলাকাটিকে গৌরবান্বিত করেছেন।
তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পাশাপাশি, বারী এলাকার শিক্ষিত যুবকদের জন্য নিজস্ব উদ্যোগের মাধ্যমে দারিদ্র জয় করে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অনুকরণীয় একজন আদর্শ উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন।”