শিরোনাম
।। শাহজাহান নবীন ।।
ঝিনাইদহ, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন মো. শিহাব উদ্দিন তুষার (৩৯)। অভাব অনটনের সংসারে এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর আর পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারেননি। জীবিকার সন্ধানে নেমে পড়েন তুষার। কিছুদিন চাকরির পেছনে ছুটেছেন। কিন্তু অন্যের কাছে শ্রম বিক্রি করতে ভালো লাগতো না। তাই নিজেই শুরু করেন মাশরুম চাষ।
তুষারের প্রথম দিনগুলো ছিল কষ্টের আর বঞ্চনার। কিন্তু আজ তুষার সফল। সংসারে অভাবের দিন ফুরিয়েছে।
মানুষ তাকে মুল্যায়ণ করে। তুষারের গড়ে তোলা মাশরুম খামারে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান হয়েছে।
সংসারের ভার নিজেই চালিয়ে যাচ্ছেন তুষার। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শে তুষারের খামারে উৎপাদন হচ্ছে উন্নতমানের স্বাস্থ্যকর মাশরুম। যা দেশের বড় বড় শহর ও অত্যাধুনিক শপিংমলে বিক্রি হচ্ছে।
শিহাব উদ্দিন তুষার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার পদ্মাকর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মৃত শওকত মীর ও জোসনা বেগম দম্পতির একমাত্র পুত্র। স্ত্রী, দুই সন্তান ও মাকে নিয়ে তার সংসার। নিজ বাড়ির আঙিনাতেই তিনি গড়ে তুলেছেন মাশরুমের দৃষ্টিনন্দন পরিপাটি শেড।
যেভাবে উদ্যোক্তা হলেন তুষার
সম্প্রতি বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তুষার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনান। তিনি জানান, চির অভাবের সংসারে এসএসসি পরীক্ষার পরে আর পড়াশুনা করতে পারেননি। কৃষিকাজ ও অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজের সন্ধান করেছেন। কিন্তু অন্যের কাছে শ্রম বিক্রি করে তুষার মানসিক স্বস্তি পেতেন না। এক পর্যায়ে তিনি নিজে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। ঝুঁকে পড়েন মাশরুম চাষের প্রতি। এখন তিনি মাশরুম চাষের পাশাপাশি মাশরুমের বীজ বা স্পন উৎপাদন করে খামারীদের কাছে বিক্রি করছেন।
তুষার বলেন, ‘মাশরুম একটি পুষ্টিকর সবজি। মাশরুম চাষের ওপর উপজেলা কৃষি অফিসের একটি ১০ দিনব্যপী প্রশিক্ষণ করেছিলাম। তার পরই আমি মাশরুম চাষে মনোযোগী হই। এটি অত্যন্ত ধৈর্য্যের একটি কাজ। বহুবার লোকসানের মুখে পড়েছি। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিইনি। আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমি সফল।’
শিহাব উদ্দিন তুষার বলেন, ‘আমি চাকরি করতে চাইনি। এজন্যই উদ্যোক্তা হয়েছি। আমার পৈত্রিক কোনো আবাদি জমিজমা নেই। তাই, বাড়ির আঙিনা ও ঘরের পেছনের জায়গাতে সেড করেছি। ছোট ছোট ৪টি সেড আছে। আমার খামারে নিজস্ব জীবাণুমুক্তকরণ অটোক্লিপ মেশিন রয়েছে। আমি নিজেই এখন মাশরুমের স্পন বা চারা তৈরি করি। আমার উৎপাদিত চারা বাজারের প্রাপ্ত চারার চেয়ে বেশি উন্নত।
তুষারের মা জোসনা বেগম (৬০) বলেন, ‘আমাদের আবাদী জায়গা জমি নেই। চাষাবাদ করে সংসার চালানোর কোনো উপায় ছিল না। অভাবের সংসারের হাল ধরার জন্য তুষার মাশরুম চাষ শুরু করে। প্রথম দিকে মানুষ নানান কথা বলতো। কেউ বলতো, ব্যাঙের ছাতা কেউ খাবে না। পাগলামী ছাড়া কিছু না। কিন্তু আমার ছেলে আজ সারাদেশে তার মাশরুম বিক্রি করে ঘরে বসেই। সংসারেও উন্নতি হয়েছে।’
যেমন চলছে তুষারের খামার
শিহাব উদ্দিন তুষার জানান, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার (৩০) খামারের নিয়মিত দেখভাল করেন। ১৪ বছর আগে ২০১০ সালে হাতেগোনা কয়েকটি স্পন নিয়ে গড়ে তোলা হয় মাশরুম খামারটি। প্রথম দিকে লোকসানের মুখে পড়েছেন তুষার। কিন্তু দমে যাননি। প্রযুক্তি ও কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। নিজের ব্যক্তিগত গবেষণার পরিধিও বেড়েছে তুষারের। এখন তিনি মাশরুম চাষের আধুনিক পদ্ধতি, প্রযুক্তির ব্যবহার ও বাজারের হালচিত্র ইন্টারনেট থেকে নিয়মিত জেনে নেন।
তুষারের খামারে এখন নিয়মিত কাজ করে স্কুল পড়ুয়া আলী (১৫), রিয়াদ (১৬) ও সাব্বির (১৬)। এ ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিমাসেই বাড়তি শ্রমিক লাগে খামারটিতে। স্কুল-কলেজে পড়ুয়া কয়েকজন খামারে নিয়মিত কাজ করেন। প্রতিদিনই ৩/৪ জন শ্রমিক লাগে খামারে।
শিহাব উদ্দিনের খামারের সহযোগী কর্মী রিয়াদ ও সাব্বির জানান, তারা পড়ালেখার পাশাপাশি মাশরুম খামারে কাজ করেন। এতে নিজেদের হাতখরচ ও খাতা-কলম কেনার খরচ নিজেরাই মেটাতে পারেন। পাশাপাশি পরিবারেও সহযোগিতা করতে পারছেন।
তুষার বলেন, আমি বেশি পড়তে পারিনি। তাই, আমার খামারে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের সুযোগ দিয়েছি। যেন আর কারও পড়াশুনা থেমে না যায়। আমার ভালো লাগে যে আমি আমার উদ্যোগের মাধ্যমে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান করতে পেরেছি। আমি চাই, মানুষ বসে না থেকে কাজ করুক। মানুষ কাজ করলে ভাতের অভাব হবে না।
তার খামারে ইরিঞ্জি, ওয়েস্টার (সকল জাত) ও মিল্কি/গ্যানোডন জাতের মাশরুম চাষ হয়। এই খামারের ৪টি সেডে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার স্পন বা মাশরুম ব্যাগ রয়েছে । প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ কেজি মাশরুম সংগ্রহ করে তা বাজারে বিক্রি করেন শিহাব উদ্দিন তুষার। এছাড়া মাশরুমের বীজ বা স্পন তৈরি করেও আয় করছেন তুষার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বড় বড় শহরে মাশরুম সরবরাহ করেন তিনি। ক্রেতারা ফোন করে অর্ডার করলে তুষার মাল কুরিয়ার বা মালবাহী গাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তুষার জানান, ভালো ভাবে যথাযথ উপায়ে চাষ করতে পারলে ৬/৭ হাজার স্পন বা মাশরুম ব্যাগ থেকে মাসে ৫০/৬০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূর-এ-নবী বাসস’কে বলেন, শিহাব উদ্দিন তুষার একজন সফল উদ্যোক্তা।
তিনি মাশরুম চাষ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। এখন তিনি মাশরুম বীজ (স্পন) উৎপাদন করছেন। স্পন বিক্রি করে লাভবান হয়েছেন। আমরা সার্বিক যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করি। সরকারি সহযোগিতা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করি। মাশরুম একটি সুপারফুড। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি জানেন না।
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, মাশরুম চাষ ঝুঁকিমুক্ত একটি উদ্যোগ। দিনদিন মাশরুমের চাহিদা বাড়ছে। এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ একটি সবজি। কিন্তু সাধারণ মানুষ মাশরুম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পায় না। আমরা মানুষের মাঝে মাশরুম নিয়ে ইতিবাচক প্রচারণার কাজ করে যাচ্ছি। তবে আগের চেয়ে শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের মাঝে মাশরুম খাওয়ার অভ্যাস বেড়েছে। এতে বাজারে মাশরুমের ভালো দাম পাচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
মাশরুম চাষ করতে বাড়তি বিশেষ জমির প্রয়োজন হয় না। ঘরের এক পাশে, এমনকি খাটের নিচেও স্পন বসিয়ে মাশরুম উৎপাদন সম্ভব বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা মো. নূর-এ-নবী।