বাসস
  ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ২০:৫৩

মেহেরপুরের জীবন সংগ্রামে জয়ী শিউলির কথা

শিউলির জীবন সংগ্রাম। ছবি : বাসস

।। দিলরুবা খাতুন ।।

মেহেরপুর, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): জীবন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল উদাহরণ মেহেরপুরের শিউলি আক্তার (৩৭)। স্বামীর মৃত্যুর পর জীবনের সব প্রতিকূলতাকে জয় করেছেন। নিজের উদ্যোম, সাহস, আত্মপ্রত্যয়, কঠোর পরিশ্রম সকল বাধাকে অতিক্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। তার এ সংগ্রামী জীবনে সহযোগিতার বদলে বেশি পেয়েছেন তিরস্কার। কিন্তু কোন তিরস্কার তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

শিউলি আক্তার ‘শিউলির রান্নাঘর’র স্বত্বাধিকারী। তার রান্নাঘরে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ জনের। অসহায় নারী পুরুষের। শিউলি প্রতিষ্ঠান থেকে নিজের সংসার চালানোর পাশাপাশি আরও পাঁচজনের সংসার চলে। শিউলি আক্তার মেহেরপুর জেলা শহরের হোটেল বাজারের আব্দুল হামিদের মেয়ে। ৩ বোন ১ ভাই । শিউলি বাবার ছোট মেয়ে।

শিউলি এইচএসসি পাস করার পর ডিগ্রি ভর্তি হয়। ২০০৭ সালে ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেন বাবা মা। আর দশ জনের মতো শিউলির জীবনেও রঙিন স্বপ্নগুলো দোলা দেয়। ভালো পাত্রস্থ হওয়ায় সে সংসার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ঢাকা শহরে। শিউলি আক্তারের স্বামী ঢাকায় ওষুধের ব্যবসা করতেন। সবার মত শিউলিরও একটি সুন্দর সংসার হয়। বিয়ের দুই বছর পর ২০০৯ সালে জন্ম নেয় জমজ দুই মেয়ে। মেয়েদের জন্মের পাঁচ মাস পরে বুঝতে পারে এক মেয়ে অটিজম। শিউলির স্বামী ওষুধ ব্যবসায়ী হওয়ায় দেশের বাইরে থেকে ওষুধ নিয়ে আসতেন। একসময় শিউলি বুঝতে পারে তার স্বামী মাদকাসক্ত।

সুখের সংসারে ধীরে ধীরে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। একদিকে অটিজম মেয়ে অন্যদিকে স্বামী মারাত্মকভাবে নেশাগ্রস্ত। নেশার টাকা জোগাড় করতে জর্জরিত হয়ে পড়ে ধার দেনায়। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে ফিরে আসতে হয় স্বামী সন্তান নিয়ে জন্মভূমি মেহেরপুরে। মাদকাসক্ত স্বামীর উপর্জনের পথ না থাকায় এক মেয়ের পড়ালেখা আরেক মেয়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে যেন আর পেরে ওঠে না।

সবার পরামর্শে শিউলি ‘শিউলির রান্নাঘর’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলে। সেখানে বন্ধু-বান্ধবসহ আত্মীয় স্বজন তার কাছে খাবার নিতে শুরু করে। শুরু হয় শিউলির জীবন সংগ্রাম। শিউলির স্বামী  সুস্থ থাকলে মাঝে মাঝে সহযোগিতা করে। এভাবে   বাড়িতে রান্না করে ক্রেতাদের ঠিকানায় খাবার পৌঁছে দেয়। বছর তিনেক পরে শহরের মল্লিকপাড়া মোড়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে বড় সড় করে শিউলির রান্নাঘর পরিচালনা শুরু হয়। পরে প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তর করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে। এসময় শিউলির স্বামী খায়রুল ইসলাম মারা যায়। শিউলির চোখে মুখে নেমে আসে অন্ধকার। সমাজের মানুষ শিউলিকে আরও বেশি তিরস্কার করতে থাকে। কিন্তু অদম্য শিউলি সবার তিরস্কারকে উপেক্ষা করে হোটেলে খাবার পরিবেশনের জন্য একজনকে নিয়োগ দিয়ে হোটেলের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। নিজে রান্না করে আবার নিজেই ক্যাশে বসে। এভাবে চলতে চলতে শিউলি আরো দুইজন মহিলাকে তার হোটেলে নিয়োগ দেয়। বৃদ্ধি পেতে থাকে শিউলির হোটেলের কার্যক্রম। এক মেয়ের পড়াশোনা আর এক মেয়ের চিকিৎসার খরচ চালিয়ে সুন্দরভাবে সংসার চলতে শুরু করে। এরপর আরো দুজনকে নিয়োগ দেয়। বর্তমানে তার হোটেলে পাঁচ জনের কর্মসংস্থান। মেয়ে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

হোটেলের পাকঘরে কথা হয় শিউলি সঙ্গে। তিনি জানান, মানুষের তিরস্কারকে পিছনে ফেলে আজ আমি স্বাবলম্বী। এখন বৃদ্ধ বাবা-মা আর দুই কন্যা সন্তানের দায়িত্বও তার। শিউলি বলেন, এখন সংসারের পাশাপাশি আরো পাঁচ জনের সংসার চলছে আমার হোটেল থেকে। ভবিষ্যতে হোটেলটাকে আরো বড় করতে চাই। আমি চাই মেয়েরা সমস্ত প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক।

শিউলির মেয়ে খুশি আক্তার বলেন, মা হোটেল ব্যবসায়ী বলে অনেকে অনেক কটুকথা বলে। কিন্তু আমি সেসব কথা আমলে নিই না। আমার মা আমার মডেল। তার জন্যই আমার এ পড়াশোনা এবং আমার বোনের চিকিৎসা সুন্দরভাবে হচ্ছে। আমরা কারোর বোঝা না। নিকট আত্মীয় স্বজন সহায়তার বদলে তিরস্কার করে।  মা ভেঙ্গে পড়ে। আমি আমার মাকে বলি তুমি কারোর কথাতে কান দিও না।

শিউলির হোটেলের পাকশালার কর্মি কদভানু। তিনি বলেন, মেয়ে মানুষের হোটেল দেখে কাজে এসেছি। মালিক মেয়ে হওয়াতে আমাদের কষ্টগুলো বোঝে। আমরা পরিবারের মতই এখানে কাজ করি। এখান থেকে যা রোজগার করি তাই দিয়ে আমাদের সংসার চলে।

শিউলির রান্নাঘর‘র কর্মচারী শরিফুল ইসলাম বলেন, হোটেলের মালিক মেয়ে মানুষ হওয়ায় অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য করে। কিন্তু আমি খুব কাছে থেকে দেখি মালিক কত কর্মঠ। কত সৎ। কষ্ট করে আজ এ জায়গায় দাঁড়িয়েছেন। আমি তার হোটেলে কাজ করতে পেরে ধন্য মনে করি। এবং যতদিন এ কাজের পেশায় থাকবো ততদিন এখানেই কাজ  করে যাব।

শিউলির পথ ধরে মেহেরপুর জেলা শহরের অনেক মেয়ে এখন শহরের পথের পাশে স্ট্রিটফুড ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করেছে। অনেকে আবার ফেরি করে মহিলাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যবসা করছেন। নিজের হাতকে কর্মের হাত করতে পেরে তারাও গর্বিত।

মেহেরপুর জেলা নিরাপদ খাদ্য অফিসার রিয়াজ মাহমুদ বাসস‘কে বলেন, শিউলির রান্নাঘরের প্যাকেট খাবার আমরা আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মানুষের মাঝে সরবরাহ করি মানসম্মত হবার কারনে। কোন অতিথি এলেও রান্নাঘরে ছুটে যায়। সেখানে হাঁসের মাংস, ভুড়ি রান্না ও ছিটা রুটি অন্য ধরনের স্বাদখুঁজে পায়।  দুইবছর আগে মেহেরপুরে যোগদানের পর শিউলির ঘুরে দাঁড়াবার কাহিনী শুনে তাকে স্বাবলম্বী করতে আমাদেরও একটা দায়িত্ব বলে মনে করি।

সমাজকর্মী মাহাবুবুল হক মন্টু বলেন, শিউলির রান্নাঘর প্রথমে আমাদের মল্লিক পাড়াতে গড়ে ওঠে। সেখানে আমরা একবার দলবদ্ধভাবে গিয়ে তার ব্যবহার ও খাবারের মান আমাদের মুগ্ধ করে। সেই থেকে এখনও আমরা শিউলির রান্নাঘরে ছুটে যাই। শিউলি খুব পরিশ্রমী এবং ধৈর্যশীল মেয়ে।