বাসস
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১:৫৪

জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্দেশনা দিতে অর্থনীতি বিষয়ক টাস্কফোর্সের সুপারিশ

১২ সদস্যের টাস্কফোর্সের প্রধান কেএএস মুরশিদ। ফাইল ছবি

ঢাকা, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : অর্থনীতির কৌশল পুনর্নির্ধারণ বিষয়ক টাস্কফোর্স ভবিষ্যতে ব্যাপকতর সংস্কারের মডেল তৈরির জন্য কিছু পাইলট প্রকল্পের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বেশ কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করেছে, যা জরুরি অর্থনৈতিক রূপান্তরের লক্ষ্যে সরকারের অঙ্গীকারের প্রতিফলন।

‘অর্থনীতি পুনর্কৌশলীকরণ এবং ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নের জন্য সম্পদ সংগ্রহ’ বিষয়ক টাস্কফোর্সের সুপারিশগুলোতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে জরুরি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব সহজতর করার জন্য একটি কৌশলগত কাঠামোর রূপরেখাও দেওয়া হয়েছে।

টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসেবার অদক্ষতা এবং পরিবেশগত উদ্বেগ বিবেচনা করে, স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারে এমন সুনির্দিষ্ট হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে।

১২ সদস্যের টাস্কফোর্সের প্রধান কেএএস মুরশিদ আজ বিকেলে নগরীর শেরে বাংলা নগর এলাকার এনইসি সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তার প্রতিবেদনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরেন।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অন্যান্য সদস্যরা ব্রিফিংয়ে বক্তব্য রাখেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থ ও তাৎক্ষণিক সম্ভাব্যতা বিবেচনায় সুপারিশগুলোতে বিভিন্ন খাত থেকে গবেষণালব্ধ উদ্যোগগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নাগরিক ও যুব গোষ্ঠীর সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, এই উদ্যোগগুলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে, পাশাপাশি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ গঠনে অবদান রাখবে।

এই সুপারিশগুলি অর্থপূর্ণ পরিবর্তনের লক্ষ্যে অনুঘটক হিসাবে কাজ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এগুলো নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সহিষ্ণু ও প্রগতিশীল সমাজের ভিত্তি স্থাপন করবে।

ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে সরকারি হাসপাতাল সংস্কার, গ্রামীণ স্কুল ও ক্লিনিক সংস্কার, বিআরটিএ সংস্কার, বুড়িগঙ্গা নদী পুনরুজ্জীবিত করা এবং একটি মন্ত্রণালয় সংস্কার।

নতুন কিছু প্রতিষ্ঠান বিবেচনা করার পাশাপাশি, টাস্কফোর্স একটি বৈশ্বিক উৎকর্ষ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশ বিমানের পুনর্মূল্যায়ন, সামাজিক ও আচরণগত পরিবর্তন যোগাযোগ ও গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, একটি নিয়ন্ত্রক সংস্কার কমিশন (আরআরসি) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তদারকি কমিটি তৈরির পরামর্শ দিয়েছে।

নগর পরিবহণ উদ্যোগের ক্ষেত্রে, টাস্কফোর্স স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাফিক সিগন্যালিং বাস্তবায়ন এবং একক-অপারেটর বাস ফ্র্যাঞ্চাইজিতে রূপান্তরের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।

উৎপাদন, বিনিয়োগ, রপ্তানি ও এফডিআই সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে, টাস্কফোর্স ‘চেরি-পিকিং উইনার’ হাইলাইট করা, ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা উন্নত করা, স্বাস্থ্য খাতে এফডিআই উৎসাহিত করা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় এফডিআই, বাজার প্রবেশাধিকারের জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতি অনুসরণ করা, দক্ষ শ্রম রপ্তানির সুযোগ গ্রহণ এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল পুনরুজ্জীবিত করার সুপারিশ করেছে।

প্রেস ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, টাস্কফোর্স সদস্যরা অল্প সময়ের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছেন।

টাস্কফোর্সের কিছু সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিমানকে পুনর্গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যাতে এটি বিমান চলাচল শিল্পে প্রতিযোগিতামূলক হিসেবে পরিণত হতে পারে।

ড. মাহমুদ জানান, প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিমানকে একটি আধুনিক ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বিমান সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং টাস্কফোর্সের প্রধান ড. কেএএস মুরশিদ বলেন, তারা তাদের কাজ পরিচালনার সময় বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন এবং প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন যাতে মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়।

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক এবং টাস্কফোর্সের সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, প্রতিবেদনে তৈরি পোশাক শিল্পের মতো ঐতিহ্যবাহী খাতের পাশাপাশি প্রযুক্তি-ভিত্তিক খাত এবং আইসিটির মতো নতুন চালিকা শক্তিতে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, তারা সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সহনশীল মুদ্রানীতি গ্রহণের বিষয়গুলি তুলে ধরেছেন।

এমসিসিআইয়ের প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর অনলাইনের মাধ্যমে ব্রিফিংয়ে যোগ দিয়ে একটি নতুন সালিসি আইন, নতুন দেউলিয়া আইন এবং ঢাকার দুটি পৌরসভাকে একীভূত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু করার পরিবর্তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু অর্থনৈতিক অঞ্চল পরিচালনা, বিডাতে ওএসএস সঠিকভাবে পরিচালনা এবং বিইআরসিকে আরও ক্ষমতায়নের পরামর্শ দেন।

টাস্কফোর্স সদস্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন ব্যাংকগুলোতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা এবং বিধি প্রতিপালন জোরদার করার পরামর্শ দেন।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনাকারীদের আগের তুলনায় আরও বেশি জবাবদিহি করতে হবে।

কিছু ক্রসকাটিং পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য, প্রতিবেদনে বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার, ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস, পরিকল্পনা প্রক্রিয়া সংস্কার, নেতৃত্বের পদে পেশাদারিত্ব, দৈনন্দিন চাঁদাবাজি মোকাবেলা, সরকারি দক্ষতা উন্নত করা, এনআইডি-ভিত্তিক উন্মুক্ত ডেটা প্ল্যাটফর্ম বাস্তবায়ন, জরুরি রিজার্ভ স্থাপন, ব্যাংকিং খাত থেকে রাজনৈতিক প্রভাব অপসারণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া, টাস্কফোর্সের সুপারিশকৃত অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সৌরশক্তির জন্য অবক্ষয়িত জমি ব্যবহার, বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্র ব্যবহার, বালি উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ, জনসেবা কল সেন্টারগুলিকে সুবিন্যস্ত করা, ‘এসএমইদের জন্য ঢাকা হাট’ প্রতিষ্ঠা এবং এসএমইগুলিকে পুনর্গঠন করা।

উপস্থাপিত পদক্ষেপ ও সুপারিশগুলি অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রাথমিক রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে এবং একটি রূপান্তরিত বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করবে যা জনগণের চাহিদার প্রতি সাড়া দেবে।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফলপ্রসূ বিভিন্ন প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও প্রশাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে, অন্তর্বর্তী সরকার সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা পুনরুদ্ধার করতে এবং টেকসই অগ্রগতির জন্য গতি ফিরিয়ে আনতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সুপারিশগুলো একটি উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলার জন্য সরকারি কর্মকর্তা ও নাগরিকদের অভিন্ন দায়িত্বের আহ্বান জানায়।

শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে, বাংলাদেশ চ্যালেঞ্জগুলোকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে পারে, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সমৃদ্ধ ন্যায়সঙ্গত ও সহনশীল জাতি গড়ে তুলতে পারে।

প্রতিবেদনটি ‘ভূমিকা’ ছাড়াও ১৭টি অধ্যায়ে প্রণীত হয়েছে। এতে দুটি বিস্তৃত অংশ রয়েছে: প্রথম অংশের শিরোনাম, সেক্টরাল আলোচনা (অধ্যায় ১-৭) যা সেক্টরাল এবং উপ-সেক্টরাল কর্মক্ষমতা পর্যালোচনা এবং মূল নীতিগত চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে, যখন দ্বিতীয় অংশটি প্রধান ‘ক্রস-কাটিং থিম’ (অধ্যায় ৮-১৭) এর ওপর আলোকপাত করেছে যেখানে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ মনোযোগের প্রয়োজন।