বাসস
  ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫১
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:৪৩

মায়ের হাতের নকশী কাঁথায় জীবনের জয়গাথা লিখে চলেছেন জাহানারা  

মায়ের হাতেই বোনা হলো জীবনের প্রথম শিল্প । লেখা হলো জীবনের জয়গাথা। ছবি ;বাসস 

বিপুল আশরাফ

চুয়াডাঙ্গা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : মায়ের হাতের নকশী কাঁথা দেখেই প্রথম নকশী কাঁথা সেলাইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন কিশোরী জাহানারা। ১৪ বছর বয়সেই প্রথম নকশী কাঁথা সেলাই করে আয় করেন তিন’শ টাকা। সেই শুরু। মায়ের হাতেই বোনা হলো জীবনের প্রথম শিল্প। লেখা হলো জীবনের জয়গাথা।  

জাহানারা যুব মহিলা সংস্থা’র নির্বাহী পরিচালক জাহানারা বেগম (৩৪)। নিজের উদ্যোগ-আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি পরিবারিক ও সামাজিক সহযোগিতায় গড়ে তুলেছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। পরিবারের পাশাপাশি অভাব ঘুচিয়েছেন এলাকার যুব নারীদের। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন অনেক নারীর। 

উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্পটা শুরু হয় ২০০৭ সালে। তখন তিনি নবম শ্রেণির ছাত্রী। মায়ের হাতে নকশী কাঁথা সেলাই করতে দেখে উদ্বুদ্ধ হন সেলাইয়ে। মায়ের কাছেই প্রথম পাঠ নেন।  মাত্র ১৪ বছর বয়সে নিজ হাতে তৈরী করেন নকশী কাঁথা । তা বিক্রি করে আয় হয় তিন’শ টাকা। সেই শুরু। 

এরপরই তৈরি করেন হাতের কাজের থ্রি পিচ। প্রথমেই বিক্রি  করেন সাত’শ টাকায়। এরপর তার আত্মবিশ্বাস  আরো বেড়ে যায়। প্রশিক্ষণ নেন হস্ত শিল্পের উপর। নিজ বাড়িতেই ভারতের নদীয়া জেলার শান্তিপুরের একটি সংস্থা তাকে ৪ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়। প্রশিক্ষণের পর প্রশিক্ষক দিলিপ বিশ্বাস ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য জাহানারাকে ২০ হাজার টাকা দেন। সেই টাকা দিয়ে জাহানারা নিজেই আরো ৭জনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেন। তাতে ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। বাকী ৫ হাজার টাকা দিয়ে কাপড় ও সুতা কেনেন নকশি কাঁথা তৈরীর জন্য। বর্তমানে তার সংস্থার তৈরী নকশী কাঁথা, চাঁদর, পাঞ্জাবী, কারচুপির  থ্রিপিচ, শাড়ীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভারতে।  

ব্যক্তিগত জীবন

চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার পলাশ পাড়ার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির কনিষ্ঠ কন্যা  জাহানারা বেগম। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট। তিনি ২০১৪ সালে রাজশাহী জেলার নওদাপাড়ার আবদুল কাদেরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক পুত্র সোয়াইব (৪)। আবদুল কাদের বরিশাল সেনাবাহিনীতে কর্মরত। 

জাহানারার জয়গাথা

পরিবারের সবার ছোট হলেও তার আত্মবিশ্বাস তাকে সবার কাছে বড় করেছে। তিনি এখন পরিবার ও সমাজের গৌরব।  

২০০৮ সালে ছোট চাচা আবদুর রহমানের পরামর্শ ও সহযোগিতায় রাজশাহী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) থেকে সেলাই ও রান্নার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এখানেই থেমে থাকেননি জাহানারা। নিজেকে আরো দক্ষ করে তুলতে ২০১০ সালে মহিলা বিষয়ক আধিদপ্তরের দর্জি বিজ্ঞান ট্রেড বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন।  সেখান থেকে প্রথম ৩০ হাজার টাকা ঋণ পান। একই বছর যুব উন্নয়নে ব্লক ও বাটিকের প্রশিক্ষণ নিয়ে ৬০ হাজার টাকা ঋণ পান। সেই টাকা দিয়েই সূচি শিল্প ও ব্লক বাটিকের কাজ সম্প্রসারণ করেন। 

বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পরিষদের আয়োজনে ২০১১ সালে ঢাকা এবং কলকাতায় আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তা সম্মেলনে যোগ দেন। মাসব্যাপী এই সম্মেলনে সেরা উদ্যোক্তা পদকে ভূষিত হন এবং ভারত থেকে বাৎসরিক শ্রেষ্ঠ অনুদান হিসাবে পান নগদ ৩ লাখ টাকা পুরস্কার। এখানেই শেষ নয়। একই বছর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে খুলনা বিভাগের অঞ্চলিক উদ্যোক্তা হিসাবে পান ১ লাখ টাকা পুরস্কার। যুব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর তার সংস্থার পণ্যের চাহিদাও বেড়ে যায়। 

২০১৮ সালে সামাজিক উন্নয়ন বিভাগে শ্রেষ্ট জয়িতা নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে যুব সংগঠক হিসেবে জাতীয় যুব পুরস্কার লাভ করেন। 

বিসিকের আয়োজনে মেলায় অংশ নিতে ইতিমধ্যেই তিনি মালেশিয়া, নেপাল ও ভারতে ভ্রমণ করেছেন। আগামী মার্চে আন্তর্জাতিক উদ্যোক্তা মেলা উপলক্ষে মিশর ও তাইওয়ান যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। 

যুব নারীদের পাশে জাহানারা

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সার্বিক তত্বাবধানে জাহানারা ২০১৮ সালে চুয়াডাঙ্গা পলাশ পাড়ায় ‘জাহানারা যুব মহিলা সংস্থা’ গড়ে তোলেন। এ সংস্থায় সেলাই, হস্ত শিল্প, ব্লক, বাটিক, নকশিকাঁথা, বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি ঝুড়ি, মাছ ধরার দোয়ারি,  বিত্তি, পলো, খাতা বাইন্ডিং  ও বিউটিফিকেশনের কাজ  শেখানো হয়। 

বাসসের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় জাহানারা যুব মহিলা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক জাহানারা খাতুন বলেন, পরিশ্রম করলে কোন কাজ বৃথা যায়না। ধৈর্য ধরতে হবে।

আমাকে অনেক সংগ্রাম করে এই অবস্থায় আসতে হয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ২০০৮ সালে এস এস সি, ২০১২ সালে এইচএসসি ও ২০১৬ সালে  বিএসসি পাশ করি। 

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং ২০২০ সালে  মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পাই। আমার সংস্থা থেকে গত ৩ বছরে ১হাজার ২শ জনকে  দর্জি বিজ্ঞান, হস্তশিল্প, সুচী শিল্পের ওপর বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বর্তমানে জুট মিল থেকে পাটের ছিট সংগ্রহ করি। সেটা দিয়ে পাটের জুতা, দড়ি, শোপিচ, ব্যাগ, গয়না, পাপোশ তৈরি ও খাতা বাইন্ডিংএর কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া বাঁশের চটা দিয়ে ঝুড়ি, মাছ ধরার দোয়ারি, বিত্তি, পলো তৈরি করে হালদার পল্লিতে বিক্রি করা হয়। 

এই সংস্থার মাধ্যমে হাতের কাজের পাশাপাশি রান্না ও বিউটিফিকেশনের  কাজ করে এলাকার গৃহিণী ও ছাত্রীরা ইতোমধ্যে স্বাবলম্বী হতে শুরু করেছে। একজন নারী কর্মী বিউটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারেন। এছাড়া হস্ত শিল্পে ২৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। হস্ত শিল্পের পাশাপাশি তিনি পাটজাত পণ্য ও বিভিন্ন ধরনের মসলাও বাজারজাত করেন। এছাড়া দেশের নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেড, স্বপ্ন বাজার, আমার দেখা হস্তশিল্প শোরুমেও এ সংস্থার পণ্য বিক্রি হয়। এছাড়াও আছে সংস্থার অনলাইন পেজ। https://www.facebook.com/share/166XKuMfqP/?mibextid=wwXIfr. এই পেজেই মিলবে সংস্থার সকল কার্যক্রমের হালনাগাদ তথ্য। 

সরেজমিনে যুব মহিলা সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, আলাদা আলাদা ৩ টি রুমে নারী কর্মিরা কাজ করছেন। কেউ শেলাই মেশিনের, কেউ খাতা বাইন্ডিং, কেউ পাটের ব্যাগ, পাপোশ, আবার কেউ বাঁশের চটা দিয়ে ঝুড়ি কিংবা পলো তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন। 

এই সংস্থার নারী কর্মী শহরতলীর আলুকদিয়া গ্রামের নাহিদা বলেন, আমি জাহানারা যুব মহিলা সংস্থায় এক বছর ধরে কাজ করছি। খাতা বাইন্ডিং, ব্যাগ শেলাই , কাঁথা শেলাইয়ের কাজ শিখেছি। মাসে ৭ হাজার টাকা বেতন পাই। সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়।

জাহানারার প্রতিষ্ঠানের পণ্য কিনতে আসা নারী উদ্যোক্তা আইভি বলেন, আমি এখান থেকে মাসে ১০/১২ হাজার টাকার পণ্য ক্রয় করি। এর মধ্যে নকশি কাঁথা, থ্রিপিচ, টুপিচ ও বেবি ফ্রক অন্যতম। 

রোজি খাতুন নামে আরেকজন ক্রেতা বলেন, আমি জাহানারার কাছ থেকে মাসে ২০/২৫ হাজার টাকার হস্ত শিল্পের মাল কিনি। এগুলো শহরে বিক্রি করি। তাতে আমার ভালোই লাভ থাকে।

২০১৬ সালে  অসহায় পথশিশুদের লেখাপড়ার জন্য পথশিশু বিদ্যালয় গড়ে তোলেন জাহানারা। তবে করোনার সময় আর্থিক সংকটের কারণে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম থেমে যায়।  

সাফল্যের প্রতিক্রিয়া

জাহানারার  বড় ভাই জাকির হোসেন বলেন, নিজের চেষ্টায় আজ সে এতদুর এগিয়েছে। প্রথম দিকে জাহানারার কর্মকান্ডে আমি খুব বিরক্ত হতাম। সেই সময় আমি আর্থিকভাবে অনেক সহযোগিতা করেছি। কিন্তু আজ ওর কর্মকান্ডের কারণেই আমাদের পরিচিতি বেড়েছে। ওকে নিয়ে আমরা গর্বিত।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, জাহানারা নারী সমাজের অহংকার। নারীদের ক্ষমতায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করছে। সে এই জেলায় কয়েকশ নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি করেছে। তারাও এখন সফল।

জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মাকসুরা জান্নাত বলেন, জাহানারা খুব পরিশ্রমী। শূন্য থেকে ওর শুরু। সে এখন আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। এই শীতে ছিন্নমূল মানুষের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করেছে। 

তিনি তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, তবেই আরো নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে।