বাসস
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৭:৫৪
আপডেট : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:৪৭

৩৬ ধরনের পোকামাকড় আক্রমণ করে বেগুনে :

বেগুনে ৩৬ ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ : বাকৃবির গবেষণা । ছবি ; বাসস

বাকৃবি (ময়মনসিংহ), ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) কীটনাশক ব্যবহার কমাতে গবেষণা করে সাফল্য পেয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষক দলের সদস্য কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।

গবেষণার বিষয়ে বাসসকে তিনি এ তথ্য জানিয়ে বলেন, গবেষণাটি পর্যবেক্ষণ করেন ভার্জিনিয়া টেকের আইপিএম ল্যাবের পরিচালক ড. মুনিয়াপ্পান।

বাংলাদেশের মানুষের কাছে বেগুন একটি প্রিয় ভোজন খাদ্য হিসেবে পরিচিত উল্লেখ করে ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ বলেন, এই বেগুন চাষে ৩৬ ধরনের পোকামাকড়ের আক্রমণ চাষিদের ভাবিয়ে তুলে । ফলে ব্যবহার করা হয়  কীটনাশক। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এই কীটনাশক ব্যবহার কমাতে গবেষণায় সাফল্য পেয়েছে।

বেগুন একদিকে যেমন পুষ্টিকর খাবার, অন্যদিকে এটি সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। চাইলে সারাবছর বেগুন চাষ করা যায়। বাংলাদেশে আলুর পরেই দ্বিতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সবজি হল বেগুন । 

২০১৮ এর বিবিএস তথ্য মতে এটি প্রায় ১২ দশমিক ৫৭ শতাংশ সবজি চাষের জমিতে চাষ হয় এবং এর উৎপাদন প্রতি হেক্টরে  ১০ দশমিক ০৮ টন। এই সম্ভাবনাময় বেগুন  বেশ কিছু ক্ষতিকর পোকার আক্রমণে পড়ে। বেগুন চাষের সময় ৩৬টিরও বেশি পোকামাকড় এটিকে আক্রান্ত করে। যার মধ্যে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক হলো ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার (Leucinodes orbonalis)  আক্রমণ।

বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনের জন্য প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার, এমনকি দিনে দুইবারও কীটনাশক প্রয়োগ করেন। 

এতো বেশি কীটনাশক ব্যবহার করা সত্বেও কৃষকরা বেগুনে ৩০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতির শিকার হন। ফলে তারা আরও বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করেন, যা এক মৌসুমে একশ’ বারেরও বেশি স্প্রে করা হয়। এতে বেগুনের ওপর উচ্চমাত্রার কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ থেকে যায়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। পুরো বেগুন চাষের খরচের ৩৫-৪০ ভাগ শুধুমাত্র কীটনাশক ও এর প্রয়োগের পেছনে ব্যয় হয়। এই অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ার পাশাপাশি কীটের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলছে। 

এর ফলে নতুন কীট সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই এর সমাধনে পরিবেশ বান্ধব বিকল্প পদ্ধতির প্রয়োজন। এই লক্ষেই  মেটিং ডিসরাপশন প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে সাফল্য পেয়েছেন ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) আইপিএম অ্যাক্টিভিটি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক।

কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ জানান, বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী স্ত্রী পোকা পাতার নিচে, ডালপালা ও ফুলের উপর ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে বের হওয়া লার্ভা গাছের নরম অংশে ঢুকে সংরক্ষিত টিস্যু খেয়ে ফেলে। ফলে গাছের উপরের অংশ শুকিয়ে মারা যায়। গাছে ফল আসলে এরা ফলে আক্রমণ করে ও ফলের অভ্যন্তরীণ অংশ খেয়ে নষ্ট করে। যা বাজারজাতকরণ ও ভোক্তার ব্যবহারের জন্য অনুপোযুক্ত করে তোলে। বাংলাদেশে এ পোকার কারণে ফলনের ক্ষতি ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। 

এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ভার্জিনিয়া টেক ও ইউএসএআইডি’র আর্থিক সহায়তায় ফিড দ্য ফিউচার মিশনের ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট এক্টিভিটি এটি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্র্রাপ্ত হয়। এই প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য ছিলো- বাংলাদেশের কৃষকদের সক্ষমতা  বৃদ্ধি করা। যেন তারা সম্মিলিতভাবে পরিবেশসম্মতভাবে ফসলের বর্তমান এবং উদ্ভূত হুমকির নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধ করতে পারে। এই প্রকল্প বেগুনসহ ১৩ টি ফসলের বালাই ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন করে।

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালে আইপিএম অ্যাক্টিভিটি ও ভার্জিনিয়া টেক  যৌথভাবে ঢাকায় একটি কর্মশালার আয়োজন করে। সেই ধারাবাহিকতায় এই প্রকল্পে এটিজিসি, ইস্পাহানী বায়োটেক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর  এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সহযোগিতায় একটি গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়িত করা হয়। মাগুরা, ঝিনাইদহে এবং বাকৃবিতে অবস্থিত জমিতে এ গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।

সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ফেরোমন। কারণ এটি রাসায়নিক বালাই নাশকের উপর নির্ভরশীল না থেকে ক্ষতিকর পোকামাকড়কে মোকাবেলা করে। ফেরোমন হলো এক শ্রেণীর সেমিওকেমিক্যাল উপাদান। যা পোকামাকড় ও অন্যান্য প্রাণীরা তার নিজ প্রজাতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে। এতে ওই পোকামাকড়  বিপরীত লিঙ্গের পোকামাকড় ও তার স্বজাতির পোকাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে তিনি জানান, মেটিং ডিসরাপশন হলো কীট দমন প্রযুক্তির একটি কৌশল, যেখানে কৃত্রিম উদ্দীপনার মাধ্যমে পোকাদের বিভ্রান্ত করা হয় এবং তাদের সঙ্গী সন্ধান ও প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত করা হয়। এতে তাদের বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে কীটের সংখ্যা কমে আসে। বেগুনের জমিতে চারা রোপণের সাত দিনের মধ্যে প্রথমবার এই মিটিং ডিসরাপসশন জেল প্রয়োগ করা হয়। যখন ছোট থাকে তখন কাঠের মাথায় এবং যখন বড় হয়ে যায় তখন প্রতি মাসে একবার গাছের ডগায় প্রয়োগ করা হয়। একইভাবে পরের মাসে দুই, পাঁচ এবং আট এভাবে সমান দূরত্বে মিটিং ডিসরাপশন জেল প্রয়োগ করা হয়েছে। এভাবে পরের মাসেও প্রয়োগ করা হয়েছে।

বেগুনের ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার পাশাপাশি আরো বেশকিছু পোকা যেমন সাদামাছি, জাব পোকাসহ ইত্যাদি পোকার মাধ্যমে বেগুন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসকল পোকা দমন এবং রোগ ব্যবস্থাপনায় জৈব বালাই নাশক ব্যবহার করা হয়েছে। 

এই গবেষণায় কোয়াড্রেট পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রতিটি বর্গক্ষেত্রের সবগুলো বেগুন গাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের পর বেগুনগুলো ভোক্তারদের জন্য সরবরাহের উপযুক্ত হলে সংগ্রহ করা হয়।