শিরোনাম
// ভুবন রায় নিখিল //
নীলফামারী, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): উত্তরাঞ্চলে পুকুরের স্বাদু পানিতে সাধারণ মুক্তার পাশাপাশি সোনালী মুক্তা চাষ করে নিজের জীবনে সোনালী দিন ফিরিয়ে এনেছেন জেলার ডোমার উপজেলার সোনারায় হাজিপাড়া গ্রামের জুলফিকার রহমান বাবলা (৪০)। নিজস্ব পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি মুক্তা চাষে সফল হয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি একই পুকুরে সোনালী মুক্তা চাষে করেও সফল হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার প্রতিষ্ঠান ‘উত্তরবঙ্গ পার্ল সিটি’র মুক্তার চাহিদা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশের বাইরে। তার মুক্তা খামার পরিদর্শন করে নিজের দেশে মুক্তা বাজার তৈরির আশ্বাস দিয়েছে রাশিয়ান প্রতিনিধিদল।
১৯৯৮ সালে প্রথম মাছ চাষ দিয়ে শুরু হলেও ক্রমে তিনি মুক্তা চাষে আগ্রহী হন। সম্প্রতি তিনি সোনালী মুক্তা চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এই সোনালী মুক্তা তার জীবনে সাফল্যের নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছে।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার সোনারায় হাজিপাড়া গ্রামের কাশেম উদ্দিন ও জাহানারা বেগম দম্পতির পুত্র জুলফিকার রহমান বাবলা। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। উচ্চ মাধ্যমিক পাশের পর যোগ দেন বিমান বাংলাদেশের চাকরিতে। তিন বছর পর হঠাৎ চাকুরি থেকে অব্যাহতি পেলে শুরু হয় তার বেকার জীবন। এরপর গ্রামে ফিরে নিজে কিছু করার পরিকল্পনা করেন।
উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প
জীবনের প্রথম চাকরি হারিয়ে খানিকটা দমে গেলেও থেমে যাননি বাবলা। জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নেন। পৈতৃক জমিতে শুরু করেন মাছ চাষ।
বাসসের সাথে আলাপকালে বাবলা জানান, পৈতৃক পুকুরে ১৯৯৮ সালে প্রথম মাছ চাষ শুরু করেন। পুকুরের আয়তন ছিল ২ একর। প্রথম ৩৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে মাছের চাষ করে এক লাখ টাকার বেশি আয় করেন। প্রথমবার মাছ চাষে সাফল্য অর্জন করায় আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় তার।
‘ত্বাকী জামান অ্যাগ্রো ফিশারিজ’ নাম দিয়ে জুলফিকার রহমান বাবলার মৎস্য খামার পরিচিতি পেতে শুরু করে। তাকে আর থেমে থাকতে হয়নি। কিন্তু বাবলা ভাবতে শুরু করেন মাছ চাষের পাশপাশি পুকুরের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের কথা।
সাফল্যের সিঁড়িতে বাবলা
মুক্তা চাষের পরিকল্পনা করার ১২ বছর পর সুযোগটি পান বাবলা। ২০১৬ সালে প্রথম ৪০ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে মুক্তা চাষ শুরু করেন। কিন্তু প্রথম দুই বছর কোন লাভ আসেনি। ২০১৮ সালে প্রথম সোয়া তিন লাখ টাকা আয় আসে।
মুক্তা চাষে সাফল্য নিশ্চিত করতে তিনি ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) থেকে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে নতুন উদ্যমে কাজে নামেন। এক বছরের মাথায় ঝিনুক থেকে মুক্তা আহরণে সফল হন। এরপর প্রকল্প এলাকা ১৫ একরে বৃদ্ধি করে শুরু করেন সোনালী মুক্তা চাষ।
জুলফিকার রহমান বাবলা বলেন, ‘আগে জেনেছিলাম মুক্তা চাষ করা যায়। কীভাবে এবং কোথায় করা যায় সেটা জানতাম না। ২০১৮ সালের জুন মাসে মাছ চাষের প্রশিক্ষণে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে (বিএফআরআই) যাই। সেখানে স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণের খবর পেয়ে জুলাই মাসে তিন দিনের মুক্তা চাষের প্রশিক্ষণ নেই। এরপর থেকে স্থানীয়ভাবে ঝিনুক ও অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে মুক্তা চাষ শুরু করি। প্রথম ৫০ হাজার ঝিনুক সংগ্রহ করে পুকুরে ছাড়ি। সেখান থেকে ৬০০টি ঝিনুকে মুক্তা পাই’।
তিনি জানান, প্রতি শতক জলাশয়ে দেশি ঝিনুক ছাড়েন ১২০টি। সেখান থেকে ৭০ থেকে ৮০টি ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। প্রতিটি ঝিনুকে মুক্তা উৎপাদন হয় এক থেকে একাধিক।
সম্প্রতি তিনি প্রকল্প এলাকার ১০টি পুকুরে ইমেজ মুক্তার পাশপাশি সোনালী মুক্তা চাষেও সফল হয়েছেন। তার উৎপাদিত সোনালী মুক্তার চাহিদা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশের বাইরে।
মুক্তা চাষ পদ্ধতি
বিএফআরআই- এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের স্বাদু পানির পুকুরে মুক্তা চাষের জন্য প্রয়োজন কিছু সরঞ্জাম। এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে ঝিনুক অপারেশনের কিটবক্স, দুই ধরণের নেট বক্স ও ইমেজ তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রপাতি। সাধারণত ১৮ থেকে ২০ মাস বয়সে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ইমেজটি স্থাপন করা হয় ঝিনুকের পেটে। এরপর দুই থেকে আড়াই ফুট পানির নিচে ডুবিয়ে রাখা হয় ঝিনুক। এভাবে ২১ থেকে ২৮ দিন রাখার পর সেগুলোকে উন্মুক্ত করা হয় পুকুরে পানিতে। এরপর আট থেকে ১০ মাসের মধ্যে স্থাপিত ইমেজটি মুক্তায় পরিণত হয়। আর গোল্ডেন মুক্তা উৎপাদনে সময় লাগে ২২ থেকে ২৫ মাস। সময়পূর্তির পর পুকুর থেকে ঝিনুক তুলে মুক্তা আহরণ করা হয় ।
বাংলাদেশে মুক্তা চাষের সম্ভাবনা
বিএফআরআই সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুক প্রাপ্তির সুবিধা, নাতিদীর্ঘ শীতকাল এবং বছরের বেশিরভাগ সময় উষ্ণ আবহাওয়া বিদ্যমান থাকায় ঝিনুক বৃদ্ধি ও মুক্তা চাষের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। তাই দেশের জলাভূমিতে মাছ চাষের সঙ্গে মুক্তা চাষ সম্ভব। মুক্তা চাষ ব্যয়বহুল নয়। কঠিনও নয়। এসব সম্ভাবনার কথা চিন্তা করেই বাংলাদেশে ২০১২ সালের দিকে স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের একটি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয় বিএফআরআই। যার মাধ্যমে মুক্তা চাষে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া হয়।
বিএফআরআই এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন বাসসকে জানান, ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি গবেষণা প্রকল্প চলমান ছিল। উক্ত প্রকল্পের অধীনে সারাদেশে ২০০০ জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রকল্পটি শেষ হলে বর্তমানে রাজস্ব খাতে গবেষণা কার্যক্রম চলমান আছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে থেকে বর্তমানে ৪২টি জেলার ৯২টি উপজেলায় দেড়শতাধিক উদ্যোক্তা মুক্তা চাষের সাথে জড়িত আছে। বর্তমানে তারা মুক্তা উৎপাদন করে দেশীয় বাজারসহ দেশের বাইরে রপ্তানি করছেন। আরো বাজার সৃষ্টির জন্য বিএফআরআই কাজ করছে। তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তা উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। সময়ের সাথে তুলনা করলে মুক্তা উৎপাদনের বাংলাদেশ চীন জাপানকে ও হারিয়ে গেছে।
উদ্যোক্তা জুলফিকার রহমান বাবলা জানান, ঝিনুক সংগ্রহ থেকে শুরু করে আহরণ পর্যন্ত প্রতিটি ইমেজ মুক্তায় খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। প্রতিটি সোনালী মুক্তা উৎপাদনে খরচ হয় ২০০ টাকা পর্যন্ত। আর প্রতিটি প্রমাণ সাইজের ইমেজ মুক্তার দাম ৫০০ থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। গোল্ডেন মুক্তার দাম ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।
চলতি মৌসুমে মুক্তা চাষে কত টাকা আয় হতে পারে জানতে চাইলে বাবলা বলেন, ‘মুক্তা থেকে বাৎসরিক আয় হয় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এ মৌসুম শেষে একই ধরণের আয় হবে বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘উত্তরবঙ্গের স্বাদু পানিতে মুক্তা চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর ব্যাপকতা ছড়িয়ে পড়লে অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।
এ বিষয়ে নীলফামারী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদ জানান, ইউরোপিয়ান দেশ বলেন, প্রাচ্যের দেশ বলেন মুক্তার ব্যবহার রয়েছে। শুধু অলঙ্কারে নয়, চিকিৎসা শাস্ত্রেও মুক্তা ব্যবহৃত হচ্ছে। আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে, রূপচর্চার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে মুক্তার চুর্ণ।
তিনি জানান, উত্তরাঞ্চলের জুলফিকার রহমান বাবলা মুক্তা চাষে একজন সফল উদ্যোক্তা। ইমেজ মুক্তাসহ গোল্ডেন (সোনালী) মুক্তা চাষ করে বাজারজাত করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। তাকে অনুসরণ করে এলাকার আরও ২০ থেকে ২৫ জন উদ্যোক্তা মুক্তা চাষে ঝুঁকেছেন।
তিনি বলেন, ‘দেশের বাইরে রাশিয়া, চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মুক্তার চাহিদা রয়েছে। আমাদের দেশেও অভিজাত শ্রেণির মানুষ দাম দিয়ে মুক্তা কিনছে। জুয়েলারি দোকানে মুক্তা বিক্রি হচ্ছে। ফার্মারদের সঙ্গে বায়ারদের যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। সরকার এ বিষয়ে এগিয়ে এলে কৃষক উপকৃত হবে, দেশ এগিয়ে যাবে এবং নতুন একটি শিল্পের বিকাশ ঘটবে। প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে’।
মো. আবু সাঈদ বলেন, উৎপাদিত মুক্তার মান বৃদ্ধির জন্য উদ্যোক্তাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে ভবিষ্যতে দেশে মুক্তা চাষের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
রাশিয়ান প্রতিনিধি দলের মুক্তা খামার পরিদর্শন: বিশ্ব বাজারে মুক্তা রপ্তানির সম্ভাবনা
সম্প্রতি বাবলার মুক্তা খামার পরিদর্শন করেছে রাশিয়ার একটি প্রতিনিধি দল। পরিদর্শন শেষে তারা উৎপাদিত মুক্তার গুণগত মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ১০ সদস্যের ওই প্রতিনিধি দলটি গত ১৮ জানুয়ারি সেখানে দিনভর অবস্থান করে মুক্তা চাষের পুরো প্রক্রিয়াটি সরেজমিনে দেখেন।
এি বষয়ে ওই প্রতিনিধি দলের প্রধান ইয়েলেনা গেস বলেন, ‘আমরা মুক্তা অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করি। এ কারণে মুক্তা চাষের বিষয়ে জানতে আগ্রহী হই। তাই সরাসরি মুক্তা চাষ দেখতে আমরা বাবলার খামারে এসেছি। এখানে মুক্তা চাষের বিষটি জানলাম এবং দেখলাম। দেখে খুব ভালো লাগলো। আমাদের দেশের (রাশিয়া) প্রচুর মানুষ মুক্তা ব্যবহার করে। সেখানে (রাশিয়া) বাবলার মুক্তার বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে আমাদের’।
এ বিষয়ে জুলফিকার রহমান বাবলা বলেন, ‘রাশিয়ার ওই প্রতিনিধি দল উৎপাদিত মুক্তা দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তারা দ্বিতীয় দফায় এসে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আশা করছি তাদের মাধ্যমে রাশিয়ায় একটি বাজার পাবো’।
বাবলার ব্যক্তি জীবন
একজন সফল উদ্যোক্তা ও মুক্তা চাষী বাবলার ঘরটি যেন আলোর নিচে অন্ধকার। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে তার বর্তমান সংসার। আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও তার একমাত্র পুত্র সন্তান রাইয়ান (১৬) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। তার এতো সাফল্যের মধ্যেও তাই কোথাও যেন নিভৃতে বয়ে চলে নিরব বেদনা।