শিরোনাম
।। মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী ।।
সুনামগঞ্জ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : তরুণ উদ্যোক্তা শাহ আলম প্রথমে শসা চাষ করে সফল হন। তারপর অন্যান্য সবজি চাষ শুরু করেন। আরো একটু অভিজ্ঞতা অর্জন করেই শুরু করেন চারা উৎপাদন। বিফল হননি কোনোটাতেই। প্রথম শসা চাষে সফল হয়ে হাত দেন সবজি চাষে। সবজি চাষেও সফল হন। এখন শসা ও সবজির পাশাপাশি সবজির চারা চাষ করছেন। তাতেও মিলেছে সাফল্য। প্রশংসা কুড়িয়েছেন এলাকাবাসীর। নিজ গ্রামের তরুণদের কাছে তিনি এখন রোল মডেল। অর্জন করেছেন সুনামগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ কৃষক পুরস্কার।
জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার পলাশ ইউনিয়নের মাঝাইর গ্রামের কৃষক কারিম উদ্দিন ও মিলিকজান দম্পতির একমাত্র পুত্র শাহ আলম (৪০)। দরিদ্র কৃষকের সন্তান হিসেবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরুতে না পারলেও নিজের উৎসাহ ও আর উদ্যমের ফলে আজ তিনি স্বাবলম্বি। নিজের দারিদ্র্য ঘুচিয়েছেন। উদ্বুদ্ধ করছেন অন্যদের।
বাসসের সাথে আলাপকালে শাহ আলম জানান, ২০০৮ সালে মাত্র ১৫ শতক জমিতে শসা চাষ করে সফল হন। প্রথমবার সফল হয়েই শাহ আলমের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। শশা চাষের লাভেই তিনি সবজি চাষ শুরু করেন। নিজের আয় থেকে আস্তে আস্তে জমি কিনে নিজে ২৩ বিঘা জমির মালিক হয়েছেন। নিজের ২৩ বিঘা ও লিজ নেওয়া ৩৭ বিঘা মিলিয়ে তিনি এখন ৬০ বিঘা জমিতে শশার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের সবজি ও সবজির চারা চাষ করেন। নিজে স্ববলম্বী হয়ে এখন স্বপ্ন দেখছেন কৃষিতেই এলাকার বেকারত্ব দূর করার। এলাকার তরুণদেরও তিনি উৎসাহিত করছেন এ কাজে।
যেভাবে শাহ আলমের পথচলা শুরু
২০০৮ সাল। দরিদ্র পরিবারে দীর্ঘ পড়ালেখার সুযোগ নেই। পরিবারের প্রয়োজন ও নিজেকে স্বাবলম্বী করাই তখন বড় চ্যালেঞ্জ। অষ্টম শ্রেণী পাস শাহ আলম বেকারত্ব ঘুচাবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখনই মাথায় চিন্তা আসে পৈতৃক জমিতে কিছু চাষ করার। প্রথমে তিনি মাত্র ১৫ শতক জমিতে শশা চাষ করেন। শশা চাষে লাভবান হওয়ায় পরের বছর তিনি ৬০ শতক জমিতে শশা, টমেটোসহ নানান জাতের শীতকালিন সবজি চাষ করেন। এতেও তার অনেক লাভ হয়। এরপর থেকে সবজি চাষের লাভের টাকা দিয়ে নিজে জমি কেনেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী ও গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে শুরু করেন নানান জাতের সবজি চাষ ও চারা উৎপাদন। তারপর আর থামতে হয়নি শাহ আলমকে।
তবে তিনি সবজি উৎপাদনের সাফল্য ধরে রাখতে সাহায্য নিয়েছেন স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন দক্ষ কৃষক।
সফল কৃষি উদ্যোক্তা :
সাফল্যের সোপানে শাহ আলম
শাহ আলমের চাষের জমি এখন ৬০ শতাংশ থেকে ৬০ বিঘায় উন্নীত হয়েছে। নিজের ২৩ বিঘার সাথে প্রতিবেশীর কাছ থেকে লিজ নেয়া জমির পরিমাণ ৩৭ বিঘা।
শাহ আলম বাসসকে জানান, এবার গ্রামের পাশের মাঠে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ১০ শতক জমিতে একটি পলিশেড নেট হাউজ তৈরী করে দিয়েছে। গত আগস্টে এ পলিশেড নেট হাউজ তৈরি করা হয়। এরপর এই নেট হাউজে তিনি বিভিন্ন ধরনের সবজি বীজ বপন করেন। গত সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি সবজির চারা বিক্রি শুরু করেন। সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত তিনি এই শেডে উৎপাদিত ২৪ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন। এছাড়াও সবজি বিক্রি করেছেন প্রায় ৪৬ লাখ টাকার। চলতি মৌসুমে তিনি আরো ১০ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করবেন বলে আশা করছেন।
তিনি আরও জানান, এবার তিনি ৪ লাখ টমেটো চারা, ২ লাখ মরিচের চারা, ১৪ হাজার পেঁপে চারা, ২০ হাজার লাউ চারা, ৬০ হাজার ফুল কপির চারা, ৬০ হাজার বেগুনের চারাসহ আরও বিভিন্ন জাতের অন্তত ২৩ লাখ সবজি চারা বিক্রি করেছেন।
তার উৎপাদিত চারা এখন নিজ গ্রাম ও আশেপাশের গ্রামের মানুষ কিনে নেয়। তিনি জানান, প্রতিটি টমেটো চারা ৩ টাকা, মরিচের চারা আড়াই থেকে ৩ টাকা, পেঁপে চারা ২৫ টাকা, লাউের চারা ও ফুল কপি চারা দেড় থেকে ২ টাকা এবং ৬০ হাজার বেগুনের চারাসহ আরও বিভিন্ন জাতের চারা প্রতিটি ৮ থেকে ১০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
পলি শেড নেট হাউজ
‘পলি শেড নেট’ ফসলকে রক্ষার জন্য এবং সূর্যের বিকিরণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এটি মূলত একটি জাল যা এইচডিপিই বা প্লাস্টিকের তৈরি। শেড নেট সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি কমিয়ে ফেলার কারণে এখানে ফসল অত্যন্ত ভালভাবে বেড়ে উঠতে পারে। সবজি চাষের জন্য শেড নেট ব্যবহার করলে সাধারণত খোলা জায়গার চেয়ে ৩৫-৫০ শতাংশ বেশি উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হল নির্দিষ্ট ঋতুকাল ছাড়াই বছর ব্যাপী শেড নেট হাউজে ফসল চাষাবাদ করা যায়।
‘পলি শেড নেট’ হাউজে তৈরি সবজির চারাও উন্নত মানের হয়। শাহ আলম পলি শেড নেট হাউজের নাম দিয়েছেন ‘এস আলম এগ্রো ফার্ম’। এবার চারা বিক্রি করে তিনি ৬০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেছেন। ৬০ বিঘা জমিতে সবজি ফলাতে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করছে। শাহ আলম জানান, এ পর্যন্ত সবজি চাষে খরচ হয়েছে ৪২ লাখ টাকা। চারা ও সবজি বিক্রি করেছেন ৭০ লাখ টাকার। এ মৌসুমে তিনি আরও অন্তত ১০ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
সাফল্যের স্বীকৃতি
প্রান্তিক শসা চাষি থেকে সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা শাহ আলমের সাফল্য দৃষ্টি কেড়েছে কৃষি বিভাগেরও। এলাকার মানুষের ভালোবাসা ও সম্মানের পাশাপাশি তিনি জয় করেছেন সাফল্যের মুকুট। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যম্যে সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ২০২৪ সালে তিনি সুনামগঞ্জ জেলার ‘শ্রেষ্ঠ কৃষক’ সম্মাননা অর্জন করেন। সবজি চাষে তার সাফল্য দেখে এলাকার অনেক যুবক সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
উপজেলার পলাশ ইউনিয়নের মেরুয়াখলা গ্রামের যুবক সবুজ মিয়া জানান, সবজি চাষে শাহ আলমের সাফল্য দেখে তিনি ২০০৯ সালে সবজি চাষ শুরু করেন। এবার তিনি ৪০ বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করেছেন। বর্তমানে তার জমিতে অন্তত ২০ জন কৃষি শ্রমিক কাজ করছে।
পলাশ ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার শফিকুল ইসলাম বাসসকে জানান, সবজি চাষে শাহ আলমের সাফল্য দেখে তার ওয়াডের্র কয়েকটি গ্রামের অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন যুবক উদ্বুদ্ধ হয়ে সবজি চাষ করে স্ববলম্বী হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নিমল চন্দ্র সোম বাসসকে জানান, বিশ্বম্ভরপুরের মাঝাইর গ্রামের শাহ আলম এ অঞ্চলে সবজি চাষে এক মডেল হয়ে উঠেছেন। তার সাফল্য দেখে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ জন বেকার যুবক সবজি চাষ করে তাদের বেকারত্ব ঘুচিয়েছে। তিনি আরও জানান, গত বছর আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সবজি চাষ করায় সিলেট অঞ্চলের কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প তাকে সুনামগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ কৃষক পুরষ্কার প্রদান করেছে। তিনি শাহ আলমের সাফল্য কামনা করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
স্বাবলম্বী হওয়ার পর ২০১১ সালে শাহ আলম সংসার জীবনে প্রবেশ করেন। বর্তমানে বাবা-মা, স্ত্রী ও তিন কন্যা নিয়ে তার সুখী পরিবার। নিজের সাফল্যে খুশী শাহ আলম বলেন, অনেক পরিশ্রমের ফলে আজ নিজের সাফল্য অর্জিত হয়েছে বলেই পরিবারকে সুখী করতে পেরেছি। বাবা-মাকে ভালো রাখতে পেরেছি। আমার সন্তানেরাও ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে।
তিনি জানান, ঢাকার আল ইন্তিফাদা ইনস্টিটিউট (আবাসিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল)-এ তার বড় মেয়ে সামিয়া ষষ্ঠ শ্রেণীতে ও মেজো মেয়ে সামিহা দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। ছোট মেয়ে সাইকা স্থানীয় একটি ইংলিম মেডিয়াম স্কুলে ভর্তি হয়েছে।