শিরোনাম
।। শফিকুল ইসলাম বেবু ।।
কুড়িগ্রাম, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : জমিতে তিন ফসল আবাদ করার আশায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন কুড়িগ্রামের কৃষকরা। এতে একদিকে যেমন তাদের উৎপাদনের সাথে সাথে আয় বাড়ছে, অন্যদিকে জেলার সয়াবিন তেলের ঘাটতি কমাতেও সহায়তা করছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার রাজারহাট উপজেলায় প্রায় ১৫ হাজার একর আবাদি কৃষি জমি রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ জমি এক ও দু’ফসলী। দীর্ঘদিন ধরে শুধুমাত্র আমন ও বোরো ধানের উপর নির্ভরশীল ছিল এই অঞ্চলের কৃষক। অপেক্ষাকৃত নীচু জমি হওয়ায় প্রতিবছর বন্যায় কিংবা ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে জমিগুলো কয়েক মাস পানিবন্দি থাকে। ফলে কৃষকদের আমন ও বোরো চাষের মাঝামাঝি সময় জমিগুলো অনাবাদি পড়ে থাকতো। বর্তমানে এসব দু’ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রুপান্তর করতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এতে করে কৃষকরা পতিত (অনাবাদি) জমি ব্যবহার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এলাকায় সরিষার বাম্পার ফলনে একদিকে রান্নার তেলের সংকট কমার পাশাপাশি কৃষি অর্থনীতিরও বিস্তার ঘটছে।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সরিষা চাষে প্রচুর রোদ, কম তাপমাত্রা ও জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকা প্রয়োজন। তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ও মাটিতে রসের অভাব হলে বীজের আকার ছোট হয় ও বীজে তেলের পরিমাণ কমে যায়। এজন্য বাংলাদেশে রবি মৌসুমেই সরিষার চাষ করা হয়ে থাকে। মধ্য কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম সপ্তাহ (প্রথম থেকে মধ্য নভেম্বর) পর্যন্ত সরিষার বপন সময়। সরিষা বোনা থেকে পাকা পর্যন্ত ৭০ থেকে ৮০ দিন সময় লাগে। তবে সরিষার ধরণ ভেদে এর বপন, উত্তোলন ও সময়সীমায় কিছুটা তারতম্য হতে পারে।
রাজারহাট সদর উপজেলার ছত্রজিৎ গ্রামের কৃষক কাজল চন্দ্র রায় জানান, আমি ২বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছি। এবার ফলন বেশ ভালো হয়েছে। আমার এই জমিতে বছরে দু’বার ফসল করতাম। কিন্তু এবার রংপুর-দিনাজপুর রিহ্যাবিলিটেশন সার্ভিস (আরডিআরএস) হতে সার,বীজ,কীটনাশক পেয়েছি। বিঘা প্রতি হালচাষ, সেচ, ঔষধ, কাটামাড়াসহ সরিষা চাষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। চলতি মৌসুমে বিঘা প্রতি সাত থেকে আট মণ সরিষা পাওয়া যাবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, বর্তমান বাজার দরে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা মণ দরে ১৮ থেকে ২০হাজার টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি।
একই এলাকার কৃষাণী শোভারাণী জানান, সয়াবিন তেলের সংকটে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়েছে। গরিব কৃষকরা নিজেদের আবাদ করা সরিষার তেল, সরিষার শাক খাওয়ার পাশাপাশি সরিষার গাছ শুকিয়ে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এতে সংসারে সাশ্রয় হচ্ছে।
বৈদ্যের বাজার গ্রামের কৃষক তারানাথ রায় বলেন, আমাদের উপজেলায় সরিষা বারি-৭, বারি-৯, বারি-১৪ চাষ হয়েছে বেশি। এরমধ্যে বারি-১৪ জাতের সরিষা কম সময়ে ফলন আসে এবং ফলনও বেশ ভালো হয়। এই সরিষা মাড়াই করে সময় মতো ধান লাগাতে পারবো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কুড়িগ্রাম জেলায় মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৩ লাখ ৮৯ হাজার ১’শ ৫৬ একর (১ লাখ ৫৭ হাজার ৫’শ ৫৩ হেক্টর)। এর মধ্যে তিন ফসল আবাদ করার উপযুক্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৯ হাজার ৬’শ ৪৩ একর। এবছর কুড়িগ্রাম জেলায় মোট ৬৩ হাজার ৩’ শ ১৮ একর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।
সুত্র জানায়, এবছর জেলায় ২৮ হাজার ৯’শ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪৪ হাজার ৭’শ ৯৫ মেট্রিক টন । কিন্তু জেলায় ২৫ হাজার ৬’শ ৩৫ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কমে ৪০ হাজার ২’শ ৪৭ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কৃষিবিদ আব্দুস সাত্তার জানান, সমন্বিত কৃষি ইউনিটের আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় আরডিআরএস-এর বাস্তবায়নে রাজারহাট উপজেলায় ১০০একর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। তেল জাতীয় ফসল চাষ সম্প্রসারণ,প্রক্রিয়াজাত ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জেলার কৃষি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। দু’ফসলি জমি থেকে তিন ফসলি জমি রুপান্তরিত হওয়ায় জমির উর্বরতা বাড়ছে, পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করছে।