শিরোনাম
\মোঃ মামুন ইসলাম\
রংপুর, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : শৈশব থেকেই চরম দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করেছেন মো. হবিবর রহমান (৩৬)। এজন্য তার লেখাপড়া করা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি বর্তমান সময়ের একজন সফল তরুণ উদ্যোক্তা। তিনি আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে তার পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামকে সফল একটি নার্সারি গ্রামে রূপান্তরিত করেছেন।
বর্তমানে গ্রামটির প্রতিটি উঠোনে একটি করে নার্সারি বাগান রয়েছে। ২০ বছর আগে নার্সারি ব্যবসায়ের পথিকৃৎ হিসেবে শুরু করা হবিবর রহমান সফলভাবে তার ভাগ্য পরিবর্তন করার পাশাপাশি এই ব্যবসায়ের মাধ্যমে গ্রামের অন্যদের স্বনির্ভরতা অর্জনের পথও দেখিয়েছেন।
তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের অধিনে এই পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামটি এখন ‘নার্সারি গ্রাম’ বা ‘চারা গ্রাম’ নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত। সেখান থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার উৎপাদিত চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে।
গ্রামের সকল রাস্তা দেশি-বিদেশি ফুল, ফল, কাঠ এবং ঔষধি গাছের সমারোহে পরিপূর্ণ হওয়ায় যে কেউ এই গ্রামে আসলে নয়নাভিরাম সবুজ প্রকৃতির মাঝে কিছুটা সুগন্ধিযুক্ত শীতল বাতাস তাকে স্বাগত জানাবে। গ্রামটির সর্বত্রই মাটিতে চারা রোপণ এবং চারা জন্মানোর জন্য জমি ও বেড তৈরির কাজ একই সাথে চলছে। গ্রামটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক পর্যটকও সেখানে গিয়ে থাকেন।
অত্যন্ত লাভজনক নার্সারি ব্যবসায়ের প্রসারের সাথে সাথে গ্রামের সকল বেকার যুবক, পুরুষ ও যুবা নারীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামটি এখন বেকারত্বমুক্ত একটি গ্রাম।
তারাগঞ্জ উপজেলা শহরটি রংপুর বিভাগীয় নগরী থেকে ২৬ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এবং রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কটি উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে গেছে। উপজেলা সদর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রাম।
গ্রামে প্রায় একশ’ ৩০টি পরিবার বাস করে। যার মধ্যে একশ’ পাঁচটি পরিবার নার্সারি ব্যবসায়ের সাথে জড়িত।
পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য তাদের নার্সারিতে জন্মানো চারাগাছের যত্ন নিয়ে দিন কাটান।
গ্রামে সারা বছর জুড়ে ৬৫ একরেরও বেশি জমিতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফুল ও ফলের চারা উৎপাদন করা হচ্ছে।
সম্প্রতি বাসস’র এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে হবিবর রহমান জানান, যখন তার মাত্র নয় বছর, তখন তার বাবা আলেপ উদ্দিন মারা যান।
তিনি বলেন, “আমি আমার মা মর্জিনা বেগম (বর্তমানে ৬০ বছর), বড় ভাই মুজিবুর রহমান, (৪২), ছোট ভাই মশিয়ার রহমান, (৩০) এবং একমাত্র বোন সোনাবী বেগম, (৪০) এর সাথে অভাবের তাড়নায় দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে দিনযাপন করছিলাম।”
তিনি তার দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে, তিনি তখন ছোট থাকায় গ্রামবাসীরা তাকে কোন কাজেই নিয়োগ দেননি।
সেই সময় তার মা মর্জিনা গ্রামের অন্যদের বাড়িতে কাজ করতেন যাতে তারা কোনোভাবে খেতে পারতেন।
হবিবর বলেন, “এই সময়ে আমি একদিন তারাগঞ্জ বাজারে আসি। একটি স্থানীয় হোটেলে প্রতিদিন ২০ টাকা মজুরী ও দিনে দু’বেলা খাবারের হিসেবে চাকরি পাই।”
তবে হোটেল মালিক তাকে সামান্য ভুল-ত্রুটির জন্য বেশিরভাগ সময় তিরস্কার করায় তিনি বেশিদিন ঐ হোটেলে থাকতে পারেননি।
একদিন হাবিবর কাজের সন্ধানে তারাগঞ্জ বাজার থেকে বাসে করে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলাধীন ঐতিহাসিক মহাস্থানগড় এলাকায় যান। তিনি প্রথমে অন্যান্য দিনমজুরদের সাথে মাঠে আলু তোলা শুরু করেন।
পরে তিনি এলাকার একটি নার্সারির মালিকের সাথে পরচিত হন। প্রায় ছয় মাস সেই নার্সারিতে কাজ করার পর কিছু টাকা জমিয়ে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন।
তার পরিবারের চরম দারিদ্র্যের কারণে তিনি বগুড়ায় আবার ফিরে গিয়ে সেই নার্সারিতে তিন মাস কাজ করেন। সেই নার্সারিতে কাজ করার সময় হবিবর কুমিল্লার একটি নার্সারির মালিকের সাথে পরিচিত হন এবং তার সাথে কুমিল্লা যান।
এক বছর কুমিল্লার সেই নার্সারিতে কাজ করার পর হবিবর জমানো কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন এবং এখন থেকে ২০ বছর আগে তিনি তার বাড়ির উঠোনে তার প্রথম নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন।
যেহেতু তখন তার নিজস্ব কোনও জমি ছিল না, তাই তিনি ৩০ শতাংশ জমি লিজ নিয়ে সেখানে চারা রোপণ শুরু করেন।
হাবিবর বলেন, “এবং এভাবেই আমার নার্সারি ব্যবসা শুরু হয়েছিল। চারা উৎপাদন শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে আমাকে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই মৌসুমে ৬০ শতাংশ জমিতে ৪৫ হাজার চারা উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে আমি এখন কাজ করছি।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমানে আমি সার, বীজ, সেচ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবহন খরচ বাদ দিয়ে বার্ষিক দুই লক্ষ টাকা আয় করি। আমার আয় ধীরে ধীরে বাড়ছে।”
তার নার্সারিতে ফলের মধ্যে কাঁঠাল, ‘আজ্জুয়া’, জলপাই, পেয়ারা, ‘চালতা’, ‘লিচু, ‘কমলা’, ‘আপেল’, ‘বরই’, ‘বেরি’, ‘নারকেল’, ‘জামরুল’, ‘গোলাপজাম’, ‘আম’, ‘আমড়া’ এবং অন্যান্য ফলের চারাই বেশিরভাগ উৎপাদিত হচ্ছে।
বনজ উদ্ভিদের মধ্যে মেহগনি, সেগুন, ‘শিলকরাই’, রেইনট্রি, ‘শিশু’, ‘রাজকরাই’ এবং ‘কদম’ এর চারা উৎপাদিত হচ্ছে।
‘নিম’, ‘হরিতকি’, ‘আমলকি’, ‘অর্জুন’, ‘শিমুল’, ‘শতমূল’, অ্যালোভেরা, ‘শঙ্খমূল’, ‘বাসক’, ‘তুলসী’, ‘পুদিনা’ এবং অন্যান্য জাতের ঔষধি গাছের চারা উৎপাদিত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “আমি দেড়শ’ প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফল, কাঠ, ঔষধি ও ফুলের গাছের চারা উৎপাদন করছি। আমার নার্সারি বাগানে চার থেকে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করে প্রতিদিন চারশ’ থেকে পাঁচশ’ টাকা আয় করেন।”
নার্সারী ব্যবসায় শুরুর সময় প্রায় ২০ বছর আগে একই এলাকার জান্নাতি বেগম (৩৫) এর সাথে হবিবরের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে দু’কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। মাত্র আট বছর বয়সে তাদের বড় কন্যা সন্তান তাউসিন অসুস্থ হয়ে মারা যায়। তার চিকিৎসায় কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয় করেও তাকে বাঁচানো যায়নি। তাদের দ্বিতীয় কন্যা সন্তান হাফসার বর্তমান বয়স ১৫ মাস।
হবিবর রহমানের পথ ধরে পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামের একশ’টিরও বেশি পরিবার এখন নার্সারি পেশায় জড়িত। প্রতিটি পরিবার এই ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করে স্বাবলম্বী হয়েছে।
একই গ্রামের বাসিন্দা হবিবরের ভাগ্নে মো. রিপন মিয়া, (২৭), ১৫ বছর আগে তার বাবা মো. গোলাপ (৪৫) এবং ভাই মো. সুজনের (৩০) সহায়তায় নার্সারি ব্যবসা শুরু করেন।
রিপন বলেন, “২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আমি নার্সারি ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। একশ’ ২০ শতাংশ জমি জুড়ে অবস্থিত আমাদের নার্সারিটিতে এখন দেড়শ’ জাতের দেশি-বিদেশি ফল, কাঠ, ফুল এবং ঔষধি গাছের ৭০ হাজার বাড়ন্ত চারা রয়েছে।”
রিপনের লক্ষ্য চলতি মৌসুমে তার নার্সারি থেকে এক লক্ষ ২০ হাজার চারা উৎপাদন ও বিক্রয় করা।
তিনি বলেন, “নার্সারি ব্যবসা পরিচালনার সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে আমার ‘রিপন নার্সারী’ থেকে প্রতি বছর চার থেকে ছয় লক্ষ টাকা নিট মুনাফা অর্জন করছি। তবে যদি আমরা এই মৌসুমে এক লক্ষ ২০ হাজার চারা বিক্রি করতে পারি, তাহলে আমরা আট লক্ষ টাকা আয় করতে পারবো বলে আশা করছি।”
রিপন বলেন, সরকারিভাবে সার, বীজ, কীটনাশকসহ বিভিন্ন সুবিধা পেলে গ্রামটিতে নার্সারী ব্যবসায়ের আরো দ্রুত প্রসারের সম্ভাবনা রয়েছে।
একইভাবে পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা বাদশা আলম, আফজাল হোসেন, মাহাবুল ইসলাম, দুলাল রহমান, জোবেদ আলী, মশিয়ার রহমান, এলাহী মাস্টার, আজিজার রহমান, আসাদুল ইসলাম, কুতুব উদ্দিন আরও অনেকে নার্সারি ব্যবসার মাধ্যমে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন।
বাসস’র সাথে আলাপকালে তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ধিবা রাণী রায় বলেন, সবুজে ঢাকা পশ্চিম কুর্শা শিকারপাড়া গ্রামের সর্বত্রই নার্সারি গড়ে উঠেছে। সেগুলিতে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি ফল, কাঠ, ঔষধি ও ফুলের গাছের চারা উৎপাদন হচ্ছে। ফলে, সেখানে বসবাসকারী সকল পরিবারের ভাগ্যের উত্তরোত্তর উন্নতি হচ্ছে।