শিরোনাম
// নুসরাত সুপ্তি //
নারায়ণগঞ্জ, ৩ মার্চ ২০২৫ (বাসস) : আরও লেখাপড়ার সাধ ছিল। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। এসএসসির পরপরই ধরতে হয় পরিবারের হাল। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরতে রিকশা চালানো শুরু করেন মোহাম্মদ হাসিব (২৬)। রিকশা চালিয়ে অর্থ উপার্জন করলেও মনের বাসনা পূরণ হচ্ছিল না তার।
রিকশা চালাতে চালাতেই ভাবতে থাকেন ভিন্নধর্মী কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু কি করবেন? বন্ধুদের সাথে আলাপ করেন। বন্ধুদের পরামর্শেই পেয়ে যান দিন বদলের চাবি। এক বন্ধুর পরামর্শে মাত্র এক হাজার টাকার মাশরুমের স্পন কিনে শুরু করেন মাশরুম চাষ৷ সেই শুরু । প্রথমে সফল হতে না পারলেও আন্তরিক চেষ্টা আর পরিশ্রমের ফলে একসময় সব বাঁধাই কাটিয়ে উঠেছেন। আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি হাসিবকে। বর্তমানে তিনি মাশরুম চাষ করেই বছরে ৭-৮ লক্ষ টাকা আয় করছেন।
পাশাপাশি অন্যদের মাশরুম চাষের পরামর্শ দিয়ে গড়ে তুলছেন নতুন উদ্যোক্তা।
জেলার বন্দর উপজেলায় তিনগাঁও গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান ও শিল্পী বেগম দম্পতির পুত্র মোহাম্মদ হাসিব। দুই ভাইয়ের মধ্যে হাসিব বড়। ছোট ভাই মোহাম্মদ রিফাত (১৪)।
হাসিবের সাথে আলাপকালে জানা যায় তার সাফল্য ও চ্যালেঞ্জের গল্প। খুব সহজেই মাশরুম চাষে সাফল্য পাননি তিনি। এজন্য তাকে অনেক পরিশ্রম ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়েছে। পাশাপাশি সঠিকভাবে মাশরুম চাষের জন্য তিনি প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।
বাসসের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, রিকশা চালাতে ভালো লাগত না। ভিন্ন কিছু করার ইচ্ছা ছিল। ২০২০ সালে আমার এক বন্ধু আমাকে মাশরুম চাষ করার কথা বলে। কিন্তু কিভাবে কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ঘন্টার পর ঘন্টা ইউটিউবে মাশরুম চাষ সংক্রান্ত ভিডিও দেখেছি। স্পন বানানোর বিষয়গুলো ভালো করে বুঝতে পারতাম না। কিছু বিষয় বুঝলেও মনে রাখতে পারতাম না। পরে সাভারের মাশরুম উন্নয়ন ইন্সটিটিউট থেকে মাশরুমের স্পন কিনে আনি। মানুষের কাছে বিক্রি করার আগে নিজে খাই। খেয়ে ভালো লাগে। পরে প্রতিবেশীকে, নিজের আত্মীয়-স্বজনকে ফ্রীতেই মাশরুম খেতে দেই। সবাইকে মাশরুমের গুণাগুণ জানাতে থাকি। কিছুদিন পর অল্প অল্প বিক্রি শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা থেকে স্পন এনে বিক্রি করে আমার কোন লাভ থাকত না। পরে সাভার মাশরুম ইন্সটিটিউট থেকে ট্রেনিং নিয়ে নিজেই শুরু করি মাশরুমের স্পন উৎপাদন। প্রথমবার চেষ্টায় আমার সব স্পন নষ্ট হয়ে যায়। পরে কয়েকবার চেষ্টা করে করে এখন আমি নিজেই মাশরুমের স্পন তৈরি করতে পারি।
মাশরুমের পাশাপাশি স্পন বিক্রি করছি নিয়মিত। এছাড়াও মাশরুমের তৈরি খাবার বিক্রিরও পরিকল্পনা রয়েছে।
হাসিব জানান, মাশরুমের স্পন প্যাকেট থেকে ২৫ - ৩০ দিনের মধ্যে ফলন আসে। ১ কেজির একটি স্পন প্যাকেট থেকে প্রায় ১ কেজি মাশরুম পাওয়া যায়। তিনি প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ কেজি মাশরুম বিক্রি করেন। প্রতি কেজি কাঁচা মাশরুমে ৮০-৯০ টাকা খরচ করে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করা যায়। এছাড়া শুকানো মাশরুম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫’শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। ৩২ টাকা খরচে একটি স্পন প্যাকেট ৪০ টাকা মূল্যে বিক্রি করেন। মাশরুম চাষ করে বছরে সাত থেকে আট লক্ষ টাকা উপার্জন করা যায়। হাসিব বলেন, প্রয়োজনীয় সরকারি সহায়তা পেলে এ বছর দ্বিগুণ আয় করতে পারবো।
হাসিবের গ্রাম তিনগাঁও এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, হাসিবের নিজস্ব জায়গা জমি নেই। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে দুই কক্ষের একটি টিনশেড ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। এক কক্ষে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন, অন্যটিকে বানিয়েছেন মাশরুম চাষের ল্যাবরেটরি কক্ষ। এখানেই তিনি মাশরুমের স্পন (বীজ) উৎপাদন করেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি জমি ইজারা নিয়ে দুটি টিনের কক্ষে মাশরুম চাষ করছেন হাসিব। মাশরুমের মৌসুমে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কর্মী দিয়ে কাজ করলেও মৌসুম ছাড়া স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েই এই কাজ করেন তিনি।
হাসিবের মা শিল্পী বেগম বাসসকে বলেন, ‘আমার ছেলের বউ, নাতি-নাতীন সবাই মিলে মাশরুমের কাজে ছেলেকে সহয়তা করে। বউ দিনে সংসারের সব কাজ শেষ করে আবার মাশরুমের কাজ শুরু করে। প্রায় প্রতিদিন রাত একটা-দেড়টা পর্যন্ত কাজ করে।’
হাসিবের এই কাজে তাকে সহয়তা করেন তার স্ত্রী সাদিয়া। তারা নিজেদের মধ্যে কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। হাসিবের স্ত্রী সাদিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী যেভাবে শিখায় দিছে সেভাবেই কাজ করি। আমি পরিশ্রম করি যেন তার স্বপ্ন পূরণ হয়। তার স্বপ্ন, মাশরুমের মতো পুষ্টিকর খাবার সকলের খাবার তালিকায় থাকবে। মাশরুমকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতায় আনার চেষ্টায় তিনি কাজ করছেন।’
হাসিবের মেয়ে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হাবিবা তাবাসসুম। নিজের মেয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হাসিব বলেন, আমার মেয়ে আমার কাজে অনেক সহায়তা করে। সকালে মক্তব থেকে আরবি পড়ে এসে কাজ শুরু করে। ১১টার দিকে স্কুলে যায়। ঘড়ির দিকে তাকায় আর কাজ করে। স্কুলে যাওয়ার আগে চেষ্টা করে তার কাজগুলো সব গুছিয়ে শেষ করার। মাঝে মধ্যে শেষ না হলে সেটা তার মা করে দেয়। বিকেলে স্কুল থেকে এসেও কাজ থাকলে খেলতে যায়না। ওর মায়ের সাথে সহায়তা করে। আমার সন্তান এবং স্ত্রী সহায়তা না করলে আমি একা সফল হতে পারতাম না।
নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়ে হাসিব বলেন, আমি বিসমিল্লাহ মাশরুম সেন্টার নামে একটি পেজ খুলেছি (https://www.facebook.com/share/15jnLrdfvW/। সেটার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন জেলায় মাশরুম বিক্রি করি। তারা আমার রিপিট ক্রেতা হয়ে গেছে। কিন্তু আমি এখানেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। আমার কাছ থেকে অনেক উদ্যোক্তা মাশরুমের স্পন নিয়ে বাজারে মাশরুম বিক্রি করে সফল হয়েছেন। কিন্তু তারা নিজেরাও স্পন তৈরি করতে আগ্রহী। আমি নিজে যতটা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, আমি চাই না অন্য কেও এগুলোর সম্মুখীন হোক। তাই মাশরুম উৎপাদন বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ সেন্টার খুলতে চাই আমি। পাশাপাশি মাশরুমের একটা ফ্যাক্টরি দিতে চাই, যেন সকলেই পুষ্টিকর মাশরুম কিনতে পারেন।
বন্দর উপজেলা কৃষি অফিসার তাসলিমা আক্তার এ বিষয়ে বলেন, মাশরুম উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রতি বছর উপজেলার ২ জন মাশরুম চাষিকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় হাসিবকে মাশরুম চাষে দুই লক্ষ সত্তর হাজার টাকা মূল্যের চাষঘর তৈরি করে দেওয়াসহ অন্যান্য সহায়তা করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সেলিমা খাতুন বলেন, মাশরুমের পুষ্টি ও ঔষধি গুণ থাকায় সারা দেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকদের মাঝে মাশরুম চাষে আগ্রহ বাড়ছে। মাশরুম চাষ বেকার সমস্যার সমাধান ও বাড়তি আয়ের উৎস হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
মাশরুম চাষে কোনো আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না। চাষের জমি না থাকলেও বসত ঘরের পাশে অব্যবহৃত জায়গা ও ঘরের বারান্দা ব্যবহার করে অধিক পরিমাণ মাশরুম উৎপাদন করা সম্ভব। মাশরুম বীজ উৎপাদনের জন্য যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন তা আমাদের দেশে সহজলভ্য ও সস্তা। এজন্য বাণিজ্যিকভাবে মাশরুম চাষে আমরা চাষিদের উৎসাহিত ও আর্থিক সহযোগিতা করছি। এই ধারাবাহিকতায় মাশরুম চাষি হাসিবকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।