বাসস
  ০৩ মার্চ ২০২৫, ১৭:১২

চট্টগ্রামে বাজারদর অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা; তবে এখনও সহনীয় 

বাজারদর অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা; তবে এখনও সহনীয় । ছবি : বাসস

 মোহাম্মদ জিগারুল ইসলাম 

চট্টগ্রাম, ৩ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : চট্টগ্রামে রোজা শুরুর সপ্তাহ খানেক আগে থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ও সহনীয় পর্যায়ে থাকলেও ক’দিন থেকে হঠাৎ করে বাজার অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা শুরু করেছে অসাধু চক্রের ব্যবসায়ীরা। 

আগে অনেকগুলো পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও অসাধু সিন্ডিকেট রোজা শুরুর পর থেকে সপ্তাহের ব্যবধানে ধীরে ধীরে দাম বাড়াতে পাঁয়তারা শুরু করেছে। 

জেলা প্রশাসনের বাজার মনিটরিং টাস্কফোর্স ও ভোক্তা অধিকার দপ্তরের নিয়মিত বাজার তদারকি রিপোর্ট অনুযায়ী, অনেকগুলো রোজার পণ্য এখনো সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। 

বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, শসা, মুরগি, মাছ ও মাংসের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে কিছুটা বাড়লেও গত কয়েক বছরের রোজার তুলনায় দাম অনেক কম বলে জানিয়েছে ক্রেতারা।
 
তবে বাজারে সয়াবিনের সঙ্কট এখনো কাটছে না। বোতলজাত সয়াবিন নিয়ে অনেকটা জুয়ায় নেমেছে বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো। এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও জেলা প্রশাসন ভোজ্য তেলের বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। 

আজ সোমবার (৩ মার্চ) দুপুরে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন ও জেলা প্রশাসক ফরিদা খানমের নেতৃত্বে যৌথ অভিযানে গিয়ে ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ডিলারদের প্রতি পণ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার ও মূল্য তালিকা দর্শনীয়ভাবে টাঙিয়ে রাখার পরামর্শ দেন। এবং ভোজ্যতেলসহ পণ্যমূল্য নিয়ে যে কোনো কারসাজির বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করেন। 

জেলা প্রশাসন সুত্র জানায়, ভোজ্যতেল নিয়ে বাজার কারসাজি ও বোতলজাত সয়াবিনের অস্বাভাবিক সংকট বিষয়ে কথা বলতে আগামীকাল মঙ্গলবার (৪ মার্চ) সকালে ভোজ্যতেলের বড় আমদানীকারক কোম্পানীর সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। 

সুত্র আরও জানায়, এ বৈঠকে আবুল খায়ের, সিটি, মেঘনা, টিকে, এসএ, এস আলমসহ বোতলজাত সয়াবিন আমদানী ও বাজারজাতকরণের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী গ্রুপগুলোর প্রতিনিধিদেরকে বৈঠকে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে। 

রোজার শুরুর প্রথমদিন রোববার ও আজ সোমবার (৩ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট, কাজীর দেউড়ি বাজার, ব্যাটারিগলি বাজার, চকবাজার, রিয়াজুদ্দিন বাজার ঘুরে রোজার পণ্যের দরদামের এমন চিত্র দেখা গেছে।

নগরীর কাজীর দেউড়ি বাজারে বাজার করেন উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন। পাশাপাশি পাঁচশো মিটার দূরত্বে রয়েছে ব্যাটারি গলি বাজার। যেখানে মধ্য ও নিম্নআয়ের লোকজনের যাতায়াত বেশি। বড় এই দুই বাজারেই রমজানের পণ্য হিসেবে চিহ্নিত বেগুন, কাঁচা মরিচ, লেবু, শসা, মুরগি, মাছ ও মাংসের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ধীরে ধীরে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। 

ক্রেতাদের অভিযোগ, অতি মুনাফালোভী কিছু সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না সরকার। এতে ক্রেতাদের জিম্মি হয়েই পণ্য কিনতে হচ্ছে। তবে ২০২৩ ও ২৪ সালের তুলনায় রোজার পণ্যের দাম অনেকটা সহনীয় বলে জানিয়েছেন তারা।
 
নগরীর বহদ্দারহাট, চকবাজার ও ব্যাটারি গলি বাজার ঘুরে দেখা যায় আলু ২৫-৩০ টাকা, ফুলকপি ৪০-৫০ টাকা, বাধা কপি ২০-২৫ টাকা, টমেটো ২৫-৩০ টাকা, বেগুন ৩০-৬০ টাকা, বরবটি ৮০ টাকা, ঢেঁড়স ১০০-১১০ টাকা, শিমের বিচি ১০০-১১০ টাকা, কচুর ছড়া ৯০-১০০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মূলা ২৫-৩০ টাকা, শালগম ৩০ টাকা, চিচিঙা ৬০ টাকা, ধুন্দল ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রমজান শুরু হওয়ায় খিরা, শসা, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতার কদরও বেড়েছে। বাজারে খিরা ও শসা বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৬০ টাকা, ধনেপাতা ১২০-১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। লেবুর হালি বিক্রি হচ্ছে সাইজভেদে ৪০ থেকে ৮০ টাকা।

ব্যাটারি গলিতে নিয়মিত বাজার করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবী কামাল উদ্দিন। তিনি বলেন, বাসার কাছে ব্যাটারি গলি বাজার থেকে নিয়মিত সদাই করি। গত দুই মাস সবজির দাম কম থাকাতে সবার মধ্যে স্বস্তি ছিল। এখন রোজাকে সামনে রেখে দোকানদাররা সবজির দাম ১০-২০ টাকা বাড়তি নিচ্ছেন। 

বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের রমজানে এখনো পর্যন্ত অনেকগুলো পণ্যের দাম সহনীয় আছে। তবে মাছ মাংস ও মুরগীর দাম কমেনি বলে তিনি জানান। 

অন্যদিকে, ফার্মের মুরগি ২০০-২১০ টাকা, সোনালি মুরগি ৩০০-৩৩০ টাকা, দেশি মুরগি ৬০০-৬৫০ টাকা. খাসির মাংস ১১০০ টাকা, গরুর মাংস (হাঁড়সহ) ৭৫০ টাকা, গরুর মাংস (হাঁড় ছাড়া) ৯০০-৯৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। 

এক সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে বলে ক্রেতা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। 

আগের সপ্তাহে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৮০-২০০ টাকা ছিল। একইভাবে সোনালি মুরগির দাম ছিল ২৮০-৩১০ টাকা হয়েছে।

নগরীর মেহেদীবাগের বাসিন্দা সেলিম কবির নিয়মিত বাজার করেন কাজীর দেউড়ি বাজার থেকে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগেও বয়লার মুরগি ১৮৫-১৯০ টাকা ছিল। এখন সেই মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০৫-২১০ টাকায়। গত দুই বছরের তুলনায় দু’একটি বাদে অধিকাংশ রমজানের পণ্যের দাম কমেছে। তখন তো ফ্যাসিস্ট সরকারের সিন্ডিকেটের কাছে বাজার দর জিম্মি ছিল। এখন তো তারা নেই, সপ্তাহের ব্যবধানে অনেকগুলো পণ্যের দাম বেড়েছে। তাহলে এখন কেন সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছেনা সরকার ?
 
ব্যাটারি গলিতে মুরগি বিক্রেতা সাদেক বলেন, ‘এখানে আমরা কিনে এনে বিক্রি করি। বেশি লাভ করার সুযোগ নেই। খামারিরা লাভবান হচ্ছে না। খামার করতে গিয়ে অনেকে লোকসানে পড়েছেন। মূলত মুরগির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন বড় বড় সিন্ডিকেট। যারা একদিনের বাচ্চা ও মুরগির ফিড উৎপাদন করেন। সরকার সিন্ডিকেটগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে মুরগির দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে।’

বাজারে সপ্তাহের ব্যবধানে মাছের দাম কিছুটা বেড়েছে। রুই মাছ দেশি রুই (জ্যান্ত) দেড় থেকে দুই কেজি ৪২০-৪৫০ টাকা, আমদানিকৃত রুই মাছ দুই থেকে তিন কেজি ৩৩০-৩৫০ টাকা, ছোট সাইজের রুই ২২০-২৮০ টাকা, এক থেকে দুই কেজি ওজনের কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে কেজি ৩৫০-৪৫০ টাকা, তিন থেকে চার কেজি ওজনের ব্রিগেট কার্প কেজি ২৫০-৩০০ টাকা, তেলাপিয়া ১৬০-১৮০ টাকা, দেশি বাইলা কেজি ৫৫০-৭০০ টাকা, শিং মাছ সাইজ অনুসারে ৪৫০-৬৫০ টাকা, মলা মাছ ৪০০-৬০০ টাকা, শোল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৮০০ টাকা, পোয়া ৩৫০ টাকা, চিংড়ি ৬০০-৮০০ টাকা, সুরমা দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ৬৫০ টাকা, কোরাল ৫৫০-৬০০ টাকা, কালিচান্দা (কেজিতে ২-৪টি সাইজের) ৩৫০-৪৫০ টাকা, ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২৮০০-৩৬০০ টাকায়।

রিয়াজ উদ্দিন বাজারের মাছ ব্যবসায়ী জামাল উদ্দিন জানান, বাজারে মাছের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে রোজা চলে আসায় মাছের চাহিদা বেড়েছে। তাই গত সপ্তাহের চেয়ে দাম একটু বাড়তির দিকে।

অন্যদিকে, বাজারে এখনো কাটেনি সয়াবিন তেলের সংকট। কোনো মুদির দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল সাজানো নেই। শুধু সয়াবিন তেল চাইলেও মিলছে না। যারা নিয়মিত বাজার করেন, কিংবা একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মুদি আইটেম কিনছেন, তাদের বাজারের আকার অনুসারে সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন মুদি দোকানিরা। তারপরেও খোলা সয়াবিন লিটারে ১৫-২৫ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, এক মাসে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ১৫ থেকে ১৭ টাকা। বিক্রি হচ্ছে ১৮৫-১৯০ টাকা লিটার দরে। এই দর সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে লিটারে ২৮ থেকে ৩৩ টাকা বেশি। খোলা তেলের দাম বোতলের তেলকে ছাড়িয়ে গেছে। বোতলের সয়াবিন তেলের নির্ধারিত দর লিটার প্রতি ১৭৫ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের দর ৮৫২ টাকা। বাজারে যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তার মোড়কে এই দরই লেখা হচ্ছে। অবশ্য খুচরা ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষেত্রে পাঁচ লিটারের বোতলের দর ১ হাজার থেকে ১১’শ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। 

কাজীর দেউড়ি বাজারে জীবন গ্রোসারির মালিক বলেন, বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ একেবারে কম। যে কারণে আমরা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেল বিক্রি করতে পারছি না।

পাইকারি বাজারের চেয়ে খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দামও বেশি। পাইকারিতে যেই পেঁয়াজ ৩৫ টাকা, সেটি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা। পাইকারিতে ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ টাকা হলেও খুচরাতে একই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকায়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সিনিয়র সকহারী কমিশনার মো. আবু রায়হান বলেন, জেলা প্রশাসনের বাজার মনিটরিং টাস্কফোর্সের মাধ্যমে মহানগর ও প্রতিটি উপজেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বাজার তদারকি করছেন। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। 

বাজার দর নিয়ন্ত্রণ রাখতে এবং অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
 
জাতীয় ভোক্তাধিকার চট্টগ্রামের উপ পরিচালক ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অতিরিক্ত দামে বিক্রির জন্য গুদামজাত করে রাখার অপরাধে ইতিমধ্যে আমাদের তদারকি অভিযান চলমান রয়েছে। অনেকগুলো মজুদদারকে জরিমানা করা হয়েছে। আমরা তাদের সতর্ক করেছি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোক্তাদের যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তারা আমাদের জানাতে পারেন, আমরা সেগুলোর ভিত্তিতে অভিযান চালাবো।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ জানান, এ বছর চট্টগ্রামে রবি মৌসুমে ক্ষীরা, বেগুন, টমেটো ও অন্যান্য সবজির উৎপাদনে বাম্পার ফলন হয়েছে। এর মধ্যে শীতের সবজি (বেগুন, টমেটোসহ) উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার টন। অন্যদিকে ক্ষীরা ৯৭৮ টন ও মরিচ ৫ হাজার ১৭৪ টন উৎপাদন হয়েছে।