বাসস
  ১২ মার্চ ২০২৫, ১৭:৩৫

৩০০ বছর ধরে বার্ষিক জিকিরের আয়োজন করা হয় যে মসজিদে

ছবি : বাসস

।। বিপুল আশরাফ ।।
চুয়াডাঙ্গা, ১২ মার্চ,  ২০২৫ (বাসস) : মুসলিম স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন চুয়াডাঙ্গার ঠাকুরপুর পীরগঞ্জ জামে মসজিদ। এই মসজিদে বিরামহীনভাবে ৯৯ বছর ধরে এলাকাবাসীর উদ্যোগে ইছালে সওয়াব ও হালকায়ে জিকিরের আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর ১২ই ফাল্গুন এ উরসের আয়োজন করা হয়। স্থানীয়দের দাবি ৩২৭ বছর আগে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। অতএব প্রায় ৩০০ বছর ধরে বার্ষিক উরসের আয়োজন করা হয় এ মসজিদে। 

বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকায় এটি স্থান না পেলেও স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, ৩২৭ বছর আগে মোঘল আমলে মসজিদটি নির্মিত হয়েছে। এমনকি অনেকে বিশ্বাস করেন, মসজিদটি রাতারাতি এক রাতের মধ্যেই তৈরি হয়েছে। 

চুয়াডাঙ্গা জেলা শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে ঠাকুরপুর গ্রামে অবস্থিত পীরগঞ্জ জামে মসজিদ। জনশ্রুতি রয়েছে ১৬৯৮ সালের দিকে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়। 

আনুমানিক, ৩২৭ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদটির নির্মাণ শৈলীর সাথে মুঘল আমলের মিল পাওয়া যায়। ১ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে পরবর্তীতে আধুনিক নির্মাণ শৈলীর সমন্বয়ে আরো দুইটি গম্বুজ বৃদ্ধি করে মসজিদটি সম্প্রসারণ করা হয়েছে। দুই তলা বিশিষ্ট এই মসজিদে একসাথে প্রায় আড়াই শো মানুষ নামাজ আদায় করতে পারেন। এছাড়া মসজিদের বাউন্ডারির এক কোনে পুরাতন মসজিদের আদলে মহিলাদের নামাজ পড়ার জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। বর্তমানে মসজিদটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ নামাজ পড়তে আসেন এই মসজিদে। মসজিদটি প্রাচীন ও ইসলামিক স্থাপত্য নিদর্শন সমৃদ্ধ। 

জনশ্রুতি অনুযায়ী, উপমহাদেশে যখন ইসলাম প্রচার শুরু হয়, ঠিক সেই সময় ১৬০০ সালের শেষের  দিকে শাহ্ মোহাম্মদ আফতাফ উদ্দিন চিশতি ওরফে আফু শাহ নদীপথে ভারতের  পশ্চিমবঙ্গ থেকে  নবগঙ্গা নদী বেয়ে চুয়াডাঙ্গার ঠাকুরপুর গ্রামে এসে একটি ঢিবির ( উচু স্থান)  উপর আস্তানা গাড়েন। তখন ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত ঠাকুরপুর গ্রাম। এখানে বসেই তিনি এলাকায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েই তখন মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী হতে শুরু করে। তখন ইবাদত বন্দেগি করার জন্য গড়ে তোলা হয় মসজিদ।  চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা এই মসজিদের পাশেই রয়েছে আফু শাহের কবরস্থান। তার পাশে রয়েছে একটি পুকুর। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঠাকুরপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পীরগঞ্জ। 

আফু শাহ ছিলেন আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। অনেকের ধারণা, আফু শাহ্ তার আস্তানাস্থলে অলৌকিক শক্তি দিয়ে জ্বীনের সহযোগিতায় রাতারাতি  একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। হাতে তৈরি পাতলা ইট আর চুন-সুড়কির গাঁথুনিতে তৈরি হয় এক গম্বুজ মসজিদ। মসজিদের ভেতরে দুই কাতারে ১২/১৩ জন নামাজ আদায় করতে পারেন।

পীরগঞ্জ ঠাকুরপুর গ্রামের বাসিন্দা গণমাধ্যম কর্মি খাইরুজ্জামান সেতু বলেন, প্রতি বছর ১২ ফাল্গুন বার্ষিক ইছালে সওয়াব ও হালকায়ে জিকিরের আয়োজন করে এলাকাবাসী। খাতা-কলমে এবার ৯৯ বছর হলেও প্রবীণ ব্যক্তিদের মুখে শুনেছি ৩শ বছরেরও অধিক সময় ধরে হয়ে আসছে এ ওরশ। ওরশের দিনে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় মসজিদ প্রাঙ্গণে। ধর্মীয় বিশ্বাসে  মানুষ এখানে ছাগল, মুরগী, টাকা মান্নত করতে নিয়ে আসে। প্রত্যেকের  জন্য রান্না করা হয় তবারক বা খিচুড়ি। ১২ ফাল্গুনকে ঘিরে  নুরনগর, ঠাকুরপুর, জাফরপুর, বেলগাছিসহ কয়েকটি গ্রামে ঈদের আমেজ বিরাজ করে।   

ঠাকুরপুর গ্রামের প্রবীণ চাঁদ আলী বলেন,  মূল মসজিদ এক গুম্বজ বিশিষ্ট। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, প্রস্থ সাড়ে ৭ ফুট, উচ্চতা ১০ ফুট। প্রবেশের দরজা  চওড়ায় ২ ফুট ও এর উচ্চতা সাড়ে ৪ ফুট এবং  পিলারের প্রস্থ আড়াই ফুট। ১৫/২০ বছর আগে যখন মসজিদের সংস্কার করা হয়। ওয়াল ভেঙে  দেখা যায় হাতে বানানো কিছুটা ছোট সাইজের ইট, চুন ও সুরকি দিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে।  

একই গ্রামের বাসিন্দা আনিস বিশ্বাস বলেন, বহুদূর থেকে মানুষ এই মসজিদে নামাজ পড়তে আসেন। বিশেষ করে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেলে মনের বাসনা পুরণের জন্য  অসংখ্য নারী-পুরুষ মসজিদে পানি ও তেলের বোতল রেখে যায়। পরদিন শুক্রবার সেই পানি ও তেল নিয়ে  যায়। কথিত আছে এই পানি পান করে ও তেল মেখে অনেকেই রোগ বালাই থেকে মুক্তি লাভ করেছে।

স্থানীয়রা জানান, চুয়াডাঙ্গা সদরের বেলগাছি গ্রামের হাজী জহির উদ্দিন বিশ্বাস,  আব্দুল কাদের বিশ্বাস, গোলাম ছোবহান বিশ্বাস ও টুনি মাহমুদ বিশ্বাসের দান করা ৩.৭ একর বা ১১ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয় মসজিদটি। এছাড়াও নাম না জানা অনেকেই মসজিদে জমি দান করেছে। 

পীরগঞ্জ জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক তাইজেল মল্লিক বলেন, ‘মসজিদটি স্থানীয়দের দানে চলে। আল্লাহর রহমত আছে এখানে। 

মসজিদের ওরস উদযাপন কমিটির আহবায়ক বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম মনি বলেন, আফতাফ উদ্দিন চিশতি ওরফে আফু শাহ ভারত থেকে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে চুয়াডাঙ্গায় আসেন। তিনি আমার পূর্বপুরুষ। আফু শাহ ৫ সন্তানের জনক ছিলেন।  তার ১ পুত্র ছিলেন নিঃসন্তান। বাকি ৪ পুত্রের বংশধরদের মধ্যে আমার দাদা ছোট তার ছোট পুত্রের সন্তান। বড় ছেলের বংশধরদের মধ্যে বেলগাছি গ্রামের আব্দুল বারি, মেজ পুত্রের বংশধর মজিদ মিয়া ও সেজ পুত্রের বংশের মফিজ মিয়া। 

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জহিরুল ইসলাম বাসসকে বলেন,  জেলার প্রাচীন নিদর্শন পিরগঞ্জ মসজিদ। বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য এখানে আসেন। তবে মসজিদটি মোঘল আমলের কিনা সেটা এখনও জানা যায়নি।