শিরোনাম
ঢাকা, ১৭ মার্চ, ২০২৫(বাসস) : হাতের তৈরি শিল্প-ই হস্তশিল্প। গ্রামীণ নারীরা নিজে কিংবা পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিয়ে সাধারণ কিছু উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন নানা বাহারি পণ্য। আর এসব পণ্যে স্থান পায় আবহমান বাঙলার রূপবৈচিত্র্য, যেখানে ফুটিয়ে তোলা হয় দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বা কারুশিল্পীদের বিশেষ উৎপাদন কৌশল। সুই-সূতা দিয়ে কারুকাজ করেই জামালপুরের বিভিন্ন এলাকার নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। এমনকি তাদের তৈরি হস্তশিল্পসামগ্রী জামালপুর ছাড়িয়ে ঢাকার বড় বড় সুপার মার্কেটের শো-রুমেও স্থান পাচ্ছে। চলে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের হাতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে জামালপুর জেলা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এ অঞ্চলের কারুশিল্পের ও হস্তশিল্পের চমৎকার নিদর্শনসমূহের মাঝে নকশি কাঁথা, মৃৎ শিল্প, কাঁসাশিল্প, নকশি পাখা, নকশি শিকা, বাঁশের তৈরি চাটাই, ধারাই, খাঁচা, কোলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। হারিয়ে যেতে থাকা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য-হস্তশিল্প বর্তমান জামালপুর জেলার হাজারো মানুষের একমাত্র অবলম্বন। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে গ্রামাঞ্চলের নারীদের ভাগ্য।
জানা গেছে, কৃষিপ্রধান জামালপুর জেলায় প্রতি বছর নদী ভাঙন ও বন্যায় অনেক মানুষের জমি নদীর বুকে বিলীন হয়ে যায়। যা সাধারণ মানুষদের হতাশাগ্রস্ত এমনকি অসহায় করে তোলে, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি করে। কিন্তু আশির দশকে জামালপুর জেলায় হস্তশিল্পের ব্যাপক প্রসারের ফলে সাধারণ মানুষ নিদারুণ দুর্ভোগ থেকে মুক্তি লাভ করে। তাদের আয়-রোজগারের বিকল্প উৎস সৃষ্টি হয়।
হস্তশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণত পুরনো কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতিদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সূতা কিনে এনে কাপড় সেলাই করা হয়। নকশি কাঁথা বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের লোকশিল্পের একটা অংশ। যা এখন ঐতিহ্য।
নকশী কাঁথা কিংবা হস্তশিল্প আবহমান কাল ধরেই এ অঞ্চলে চলে আসছে। তবে ৭০ দশকের শেষভাগে এ শিল্পকে পুনরুদ্ধার করে বাণিজ্যিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় গতিযোগ করে ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’।
কুটিরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা জানান, ব্র্যাক জামালপুরের বিভিন্ন গ্রামের সূচি শিল্পীদের খুঁজে বের করে নকশী কাঁথা শিল্পের নবউত্থান ঘটায়। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সংঘ ১ হাজার গ্রামীণ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নকশী কাঁথার কার্যক্রম শুরু করে।
রুমা হস্তশিল্পের কর্ণধার আরিফা সুলতানা বলেন, মূলত এরপরই গ্রামীণ নারীদের মধ্যে হস্তশিল্পের নবউত্থান ঘটে। এখন আমরা কাপড় ও সূতা কিনে গ্রামে নারীদের মাঝে দিই। তারা পণ্য সামগ্রী তৈরি করে একটা নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দিয়ে যায়। এতে তারা স্বাবলম্বী। পরিবারে ভূমিকা রাখতে পারছে।
জামালপুর সুইটেক্সের কর্মী শামীম সুলতানা বলেন, বেশির ভাগ গ্রামের নারী এই শিল্পে দক্ষ। কেননা গ্রামের বেশির ভাগ নারী-ই তাদের অবসর সময় নকশি কাঁথা সেলাই করে থাকেন। এক একটি কাঁথা সেলাই করতে অনেক সময়, এমনকি এক বছর সময়ও লেগে যায়।
নকশী কাঁথা নিয়ে কথা প্রসঙ্গে আশেক মাহমুদ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সাহিত্যিক প্রফেসর ড. মুজাহিদ বিল্লাহ ফারুকী বলেন, নতুন জামাইকে বা নাত বউকে উপহার দেয়ার জন্য নানি-দাদিরা নকশি কাঁথা সেলাই করেন। এক একটি কাঁথা সেলাইয়ের পেছনে অনেক হাসি-কান্নার কাহিনী থাকে। বিকেল বেলা বা রাতের খাবারের পর নারীরা এক সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে এক একটি কাঁথা সেলাই করেন। তাই বলা হয় নকশি কাঁথা এক একজনের মনের কথা বলে।
‘কাঁথায় নকশা করার পূর্বে কোন কিছু দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। তারপর সুঁই-সূতা দিয়ে ওই আঁকা বরাবর সেলাই করা হয়। কাঁথায় সাধারণত মধ্যের অংশের নকশা আগে করা হয় এবং ধীরে ধীরে চারপাশের নকশা করা হয়। আগে কিছু কাঁথার নকশা আঁকানোর জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হতো, এখন ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করা হয়,’ যোগ করেন তিনি।
অর্থনৈতিক দিকটি তুলে ধরে প্রফেসর ফারুকী বলেন, বাড়তি কোনো পুঁজি বিনিয়োগ না করে শুধু শ্রম দিয়ে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। এতে আয় যেমন বাড়ছে তেমনই কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয়েছে। বেকারত্ব লাঘব হয় ও হতাশা হ্রাস পায়, মানুষ কর্মমুখী হয়। বর্তমানে এ অঞ্চলের প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ পরিবারের সন্তানরাই নিজেদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে নিপুণভাবে হস্তশিল্পের কাজ করে থাকে।
মূলত বর্ষাকালে কাঁথা সেলাই করা হয়। একটা প্রমাণ মাপের কাঁথা তৈরিতে ৫ থেকে ৭ টা শাড়ি দরকার হয়। আজকাল পুরান সামগ্রীর বদলে সূতির কাপড় ব্যবহার করা হয়। কাঁথার কারিগর মেলান্দহের চরপালিশা গ্রামের বেগম আখতার বলেন, কাঁথা তৈরিতে পুরান কাপড়ের ব্যবহার কমে গেছে।
নকশী কাঁথা সেলাই করে এখন স্বাবলম্বী দুইবোন রুবা ও ডেইজি আকন্দ। শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পর তারা আর্থিক সঙ্কটে পড়েন। এক পর্যায়ে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে হস্তশিল্পের কাজে যোগ দেন। এখন তাদের অবস্থা বেশ ভালো। তারা বলেন, মা, একভাইকে নিয়ে তারা এখন স্বচ্ছল জীবন যাপন করছেন।
কলেজ রোডের মরিয়ম বেগম বলেন, আমি নিজের পরিবারের খরচ নিজেই করছি। আমার এক ছেলে ও দুই মেয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। তাদের খরচও মেটাতে পারছি।
জানা গেছে, জামালপুরের ইসলামপুর, জামালপুর সদর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ, সরিষাবাড়ীতে নকশী কাঁথা ও নকশী চাদর তৈরি করা হয়। এছাড়া ব্যাগ, হাতের কারুকাজময় অন্যান্য সামগ্রী—এখন সারা দেশে সমাদৃত। দারিদ্র্য বিমোচনেও এ জেলার শিল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ নাজমুল হুদা বলেন, যেহেতু দেশের বাইরেও এসব পণ্যসামগ্রীর চাহিদা রয়েছে তাই রপ্তানি কার্যক্রম সহজ হলে জাতীয় অর্থনীতিতে এ শিল্পের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি পোশাক শিল্পের পরই জামালপুরের হস্তশিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ প্রবাহ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
‘হস্তশিল্প পণ্যের নিজস্ব বাজার গড়ে উঠলে হত দরিদ্র নারী শ্রমিকরা একদিকে যেমন তাদের সঠিক শ্রম মূল্য পাবেন, পাশাপাশি দরিদ্র এই জেলায় গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্রও পুরো পাল্টে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
জানা যায়, হস্তশিল্পের প্রসারকে কেন্দ্র করে জামালপুর জেলার সকল উপজেলাতেই প্রায় ৪০০ এর মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে নকশী কাঁথা ছাড়াও বেড কভার, থ্রিপিস, ওয়ালমেট, কুশন কভার, শাড়ি, পাঞ্জাবি, টি শার্ট, ফতুয়া, স্কার্ট, লেডিজ পাঞ্জাবি, ইয়ক, পার্স, বালিশের কভার, টিভি কভার, শাড়ির পাড়, শাল, চাদর তৈরি হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা যেমন পূরণ করছে, অন্যদিকে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
জামালপুর শহরে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জেলা শহরে এ শিল্পের ছোট-বড় অনেক শো-রুম গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বকুল তলা, মাদ্রাসা রোড, কলেজ রোড, আজম চত্বরসহ অলিতে গলিতে গড়ে উঠেছে হস্তশিল্পের শোরুম। কিন্তু বিপণন সমস্যা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা আর পুঁজির অভাবে শ্রমের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার নারী কর্মীরা। ইচ্ছে মতো মালিকের দেয়া অল্প মজুরিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের।
তবে স্থানীয় ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি নকশী কাঁথা তৈরি করতে মজুরিসহ খরচ হয় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা। ঢাকার পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে তা বিক্রি করতে হয় ২০০০ টাকায়। এই কাঁথা ঢাকার বড় বড় বিপণী বিতানগুলোতে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ হাজার টাকায় । পুঁজির অভাবে তারা নিজেরা বাজারজাত করতে পারছেন না এসব পণ্য। ফলে পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে নিজেরা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি যথাযথ শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না নারী শ্রমিকরাও।
হস্তশিল্প অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, হস্তশিল্প ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ব্যাংক কিংবা এনজিও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। অন্যান্য অর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ সহায়তা পেলে এখানকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সরাসরি এসব সূঁচি পণ্য ঢাকাসহ বড় শহরে নিজেরাই বিপণন করতে পারবে।