শিরোনাম
বাবুল আখতার রানা
নওগাঁ, ১৯ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : টুপি তৈরির ধুম পড়েছে নওগাঁর মহাদেবপুর ও নিয়ামতপুর উপজেলার গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার নারীদের মধ্যে। তাদের নকশা করা টুপি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির পাশাপাশি রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত ও কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। জেলার প্রায় ৩০ হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে টুপি তৈরিতে। এতে করে যেখান থেকে প্রতি বছর প্রায় শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন স্থানীয় উদ্যোক্তারা।
মহাদেবপুর উপজেলা শহর সংলগ্ন খোসালপুর, চকগোবিন্দপুর, মধুবন এবং শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে উপজেলার উত্তরগ্রাম ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম শিবরামপুর, ভালাইন, লক্ষ্মনপুর, সুলতানপুর, রামচন্দ্রপুর, হেরেমনগর, বিল মোহাম্মদপুর গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, সংসারের কাজের ফাঁকে দৃষ্টিনন্দন টুপির কারুকাজে ব্যস্ত গ্রামের প্রতিটি পরিবারের নারীরা। আসন্ন ঈদকে ঘিরে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে কয়েকগুন। টুপি সেলাই করতে কেবল গৃহিনীরাই নন, স্কুল-কলেজের মেয়েরাও ব্যস্ত। সুই-সূতায় নকশা তুলে টুপি তৈরির কাজ করছেন দিন-রাত।
মহাদেবপুর সদর ইউনিয়নের খোসালপুর স্কুল পাড়ার আঞ্জুয়ারা বেগম বাসস’কে জানান, বসতবাড়ি ছাড়া তাদের তেমন কোনো জমি-জমা নেই। রিকশা চালক স্বামীর আয়ে চারজনের সংসার টানাপোড়নের মধ্য চলছিল। টুপি সেলাইয়ের কাজ করে সংসারে এখন স্বচ্ছলতা এসেছে। টুপিতে নকশা তোলার কাজ করে তার স্বামীকে একটি অটোরিকশা কিনে দিয়েছেন তিনি। তাদের দুই সন্তান। এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়েটি এবার ৮ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। আর ছেলে ৩য় শ্রেণির ছাত্র। লেখাপড়ার পাশাপাশি মেয়ে কবিতাও মায়ের সঙ্গে টুপি সেলাইয়ের কাজ করে। মা-মেয়ে দুইজনে মাসে কমপক্ষে তিন হাজার টাকা আয় করে।
মহাদেবপুর উপজেলার খোসালপুর গ্রামের একটি আম বাগানে ১০-১২জন মহিলা একসঙ্গে বসে টুপিতে নকশা তোলার কাজ করছিলেন। গল্প করতে করতে চলছিল নকশা তোলার কাজ। সেখানে কথা হয় সাবিনা, রওশন আরা, সুমাইয়া, নাদিয়া, সুলতানা, লাইলী, রুবিনাসহ আরও কয়েকজন গৃহিণীর সঙ্গে। তাঁরা বাসস’কেজানালেন, অবসর সময় ছাড়াও সংসারের কাজের সঙ্গে সঙ্গেই এ কাজ করা যায়। সারা বছরই তাঁরা টুপি সেলাইয়ের কাজ করেন। তবে সারা বছর টুপির চাহিদা থাকলেও রোজার মাস ও দুই ঈদে টুপির চাহিদা বেশি থাকে। এ সময়ে কাজের অর্ডারও বেশি পাওয়া যায়। সংসারের কাজের পাশাপাশি একেকজন ৯০ থেকে ১০০টি টুপিতে নকশা তুলতে পারেন। তাঁরা আরো জানালেন, মহাজনরা তাদের কাছে চাহিদা মোতাবেক টুপির কাপড় দিয়ে যান। কোনো কোনো কাপড়ে ডিজাইনদের নকশা আঁকা থাকে। এসব নকশার ওপর সূতা তুলতে হয় তাঁদের। ডিজাইনারদের নকশা করা কাপড়ে সূতা তুলে দিলে প্রতি টুপিতে ২৫ টাকা করে পাওয়া যায়। আর যারা নিজেরাই নকশা করে টুপিতে সূতা দিয়ে ফুল তোলে তারা প্রতি টুপিতে ২০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত পায়।
কথা হয় গ্রামের এসব কারিগরদের কাছে টুপির কাপড় সরবরাহ করে এমন একজন মহাদেবপুর উপজেলার মধুবনের খোরশেদ আলম। তিনি বাসস’কেবলেন, আমি মহাজনদের কাছ থেকে টুপির কাপড় এনে গ্রামের নারীদের কাছে সরবরাহ করি। উপজেলার তিনটি গ্রামের অত্যন্ত এক হাজার কারিগরের কাছে টুপির কাপড় দেওয়া আছে। তিনি আরো জানান, নওগাঁসহ নোয়াখালী, ফেনীর যেসব প্রবাসী মধ্যপ্রচ্যে রয়েছেন তারাই মূলত টুপির এ ব্যবসা করে থাকে। এদেশে তাঁদের এজেন্ট রয়েছে। তারাই আমাদেরকে এসব টুপির কাপড় সরবরাহ করে। আমরা আবার সেগুলো কারিগরদের কাছে পৌঁছে দেই।
মহাদেবপুরের এসব নারীর মতো টুপি সেলাই করে নিজেদের জীবন-জীবিকায় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন নিয়ামতপুর উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের সিদাইন, আমইল, গাবতলী, ধর্মপুর, পাইকড়া, চন্দননগর ইউনিয়নের ছাতড়া, হাজিনগর ইউনিয়নের কুশমইল গ্রামের কয়েকশ পরিবারের নারী। এসব গ্রামের কয়েকশ পরিবারের নারীরা এ টুপি সেলাইয়ের কাজ করেন। অনেকের অভাবের পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা।
নিয়ামতপুর উপজেলার সিদাইন গ্রামের আফজাল হোসেন বাসস’কে জানান, তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে শাবানা কলেজে পড়ালেখা করেন। আর ছোট মেয়ে জেরিনা পড়ে হাইস্কুলে। অর্থের অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। ।ঠিক এমন সময় টুপি বুনানোর কাজ হাতে পান তাঁর স্ত্রী জুলেখা। পড়ালেখার পাশাপাশি মায়ের সঙ্গে টুপি সেলাই করে তারাও। এতে পড়ার খরচ যোগান দিয়ে সংসারের আর্থিক সহযোগিতা করছে তরা। তার সংসারে টুপি সেলাই করে এখন মাসে কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা আয় হয়। স্ত্রী ও মেয়েদের সেলাই করা এসব টুপির মহাজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়ায় তাঁর এখন প্রধান কাজ।
বিদেশী এসব টুপি তৈরির অর্ডার নিয়ে নিয়ামতপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কারিগরদের সরবরাহ করেন কুশমইল গ্রামের সাদেকুল। তিনি বাসস’কে জানান, আগে তাঁর একটি টুপির দোকানের ব্যবসা ছিল। ওই ব্যবসার সূত্রে বিদেশী টুপি তৈরির অর্ডার দেয় নওগাঁতে জহির উদ্দিন নামে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিদেশী টুপির অর্ডার নিয়ে এলাকায় কারিগরদের টুপির কাপড় দেন সেগুলোতে নকশা তুলতে। পরে অন্য আরও মেয়েদের চাহিদা দেখে আরও টুপির অর্ডার নিয়ে আসেন। বর্তমানে নিয়ামতপুরে অন্তত ১৫টি গ্রামে এসব টুপি তৈরি করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
কথা হয় নওগাঁর টুপি ব্যবসায়ী মোসলেম উদ্দীন ও দেলওয়ার হোসেনের সঙ্গে। দুজনেই দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন। তাঁরা বাসস’কে জানালেন, নওগাঁর মহাদেবপুর, নিয়ামতপুর, ধামইরহাট ও পত্মীতলা উপজেলার ৪৫-৫০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার নারী বিদেশী এসব টুপিতে নকশা তোলার কাজ করছেন। টুপিতে নকশা তোলার কাজ হওয়ার পর ওইসব টুপির ওপরে ও নিচে দুটি অংশে রেশমি সূতা লাগানোর কাজ করা হয়। এগুলোও গ্রামের কারিগররাই করে। কাজ শেষ হলে ওই টুপিগুলো তাদের লোক গিয়ে সেগুলো নওগাঁতে নিয়ে আসে। এরপর নকশা করা টুপিগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। কাপড় ও নকশাভেদে সেখানে প্রতিটি টুপি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়।
নওগাঁ শহরের আয়মান হস্তশিল্পের স্বত্বাধিকারী জীবন আহম্মেদ বাসস’কে বলেন, নারী এ পেশায় নিয়োজিত। পুরুষরা এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকেন। বর্তমানে তাঁর অধীনে প্রায় ৬ হাজারের অধিক নারী শ্রমিক টুপি তৈরির কাজ করছেন। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের টুপি ওমানে রপ্তানির টার্গেট রেখেছিলাম। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ টুপি ওমানে পাঠানো হয়েছে। বাঁকিগুলো পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বাসস’কে বলেন, রপ্তানিযোগ্য টুপি তৈরির শিল্প থেকে একদিকে জেলায় প্রায় ৩০ হাজার নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। অন্যদিকে এ শিল্প থেকে প্রতি বছর অন্তত প্রায় শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। নারীদের প্রয়োজনীয় কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বিসিকের। পাশাপাশি এ হস্তশিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তারা চাইলে তাদের সহজ শর্তে ঋণ পেতে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বাসস’কে বলেন, নওগাঁর তৈরি টুপি বিদেশে রপ্তানি হয় বিষয়টি ভাবতে ভালো লাগে। টুপি তৈরি করে এলাকার হতদরিদ্র পরিবারগুলোর স্বচ্ছলতা ফিরে আসছে। এদের প্রচেষ্টার কোনো তুলনা হয় না।